অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া কারাদণ্ডাদেশ হাইকোর্টে বহাল থাকায় আইন অনুযায়ী হাজী মো. সেলিম তাঁর সংসদ সদস্য পদ হারাবেন বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী। তবে হাজী সেলিমের আইনজীবীর দাবি, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার জাতীয় সংসদের স্পিকারের। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে কারাদণ্ডের রায় বহাল থাকায় হাজী সেলিমকে কারাগারে যেতে হবে বলেও জানান আইনবিদেরা। এ প্রসঙ্গে সেলিমের আইনজীবী জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল বিভাগে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইবেন তাঁরা।
এর আগে গত বছরের ৯ মার্চ দুদকের ওই মামলায় ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। গত বুধবার ওই রায়ে স্বাক্ষর করেন বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক। গতকাল ৬৬ পৃষ্ঠার ওই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত রায়ে হাজী সেলিমকে ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। এরপর তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করতে পারবেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক পদধারী হলেও তাঁকে বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে হবে। দুদকের প্রতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে হাইকোর্ট বলেন, ‘সাংবিধানিক পদধারী বা পদধারী নন অথবা তিনি যেই হোন না কেন, দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে তাঁকে বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনার কারণেই দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে আমরা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।’
পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছেন, ‘আমরা সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, এখন পর্যন্ত দুদক এ রকম হাজারো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এর জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নির্ভর করে আছে।
রায়ে দুর্নীতিকে মানসিক ব্যাধি আখ্যায়িত করে হাইকোর্ট বলেন, এতে বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষ আসক্ত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে দুদক, বিচার বিভাগসহ সরকারি-বেসরকারি এবং আদালতের প্রধানেরা সমন্বিতভাবে তাঁদের সতর্ক করে বার্তা দেবেন। যদিও এ কাজ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। একজন সৎ ব্যক্তি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খপ্পরে পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু তারপরও দুর্নীতিমুক্ত জাতি ও সমাজ গঠনে এ কাজ শুরু করতে হবে।
রায় প্রকাশের পর দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, বিচারিক আদালত রায়ের কপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকায় হাজী সেলিম সংসদ সদস্য পদ হারাবেন বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘রায় নিয়ে ওনার (হাজী সেলিম) সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আপিল বিভাগে আবেদন করব। সংসদ সদস্য পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার জাতীয় সংসদের স্পিকারের। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করে আপিল বিভাগে জামিন চাওয়া হবে।’
২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং ৫৯ কোটি ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ১৩২ টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করে দুদক। ওই মামলায় ২০০৮ সালে হাজী সেলিমকে দুদক আইনের দুটি ধারায় মোট ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত।
২০০৯ সালে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন হাজী সেলিম। ২০১১ সালে ওই সাজা বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনরায় শুনানি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। নির্দেশ অনুযায়ী ২০২০ সালের মামলাটি শুনানির উদ্যোগ নেয় দুদক। শুনানিতে হাজী সেলিমের মামলার যাবতীয় নথি তলব করেন হাইকোর্ট। নথি পাওয়ার পর গত বছরের ৩১ জানুয়ারি শুরু হয় পুনঃ শুনানি। এরপর গত বছরের ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে আংশিক আপিল মঞ্জুর করে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তথ্য গোপনের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি ৩ বছরের কারাদণ্ড থেকে হাজী সেলিমকে খালাস দেওয়া হয়।
আপিল বিভাগে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইবেন হাজী সেলিম
RELATED ARTICLES