মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় পাখির ছানা ধরতে গিয়ে টিলা ধসে মাটি চাপায় নিহত ৩ মাদ্রাসা ছাত্রের বাড়ি, গ্রাম ও উপজেলা জুড়ে চলছে শোকের মাতম।
মূলত ভাটেরার ওই রাবার বাগানের টিলা পাশ দিয়ে প্রবাহমান পাহাড়ী ঘাগড়া ছড়া। ছড়া থেকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র টিলায় গর্ত করে মাটি ও বালু বিক্রি করার ফলে মরণ ফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে।একারণে টিলার মাটি ধসে পড়ে ৩ ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
একই গ্রামের তিন ছাত্র নিহতের ঘটনায় ভাটেরা ইউনিয়নের ইসলামনগর গ্রাম এখন শোকে বিহব্বল দুর দুরান্ত থেকে লোকজন এসে শোকের মাতমে শরিক হচ্ছেন। কেউ কেউ যাচ্ছেন ঘটনাস্থল দেখতে। কেউ কেউ যাচ্ছেন নিহত ৩ মাদ্রাসা ছাত্রের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে।
কুলাউড়া উপজেলার প্রায় প্রত্যেক মানুষের মুখে তিনছাত্র নিহতের ঘটনা নিয়ে আলোচনা আর আক্ষেপ প্রতিয়মান হচ্ছে।
সরেজমিন ইসলামনগর এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে বেরিয়ে আসে ৩ মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়ার নেপথ্যের কারণ। মুলত যে স্থানটিতে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতাধীন ভাটেরা রাবার বাগান এলাকা। ওই এলাকা দিয়ে প্রবাহমান পাহাড়ী ঘাগড়া ছড়ার তীরে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ওই পাহাড়ী ছড়ার বালু এবং টিলায় গর্ত করে মাটি ও বালু বিক্রি করার ফলে এই মরণ ফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে। এরকম অসংখ্য মরণ ফাঁদ দেখা গেছে গোটা এলাকায়।ইসলামনগর গ্রামে নিহত নাহিদ ইসলামের (১২) মা রায়না বেগম, কবির আহমদের (৯) মা রাবেয়া বেগমের আহাজারিতে যেন গোটা এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। আর সুমন আহমদের (১৪) মা মনোয়ারা বেগমকে কোরআন তেলওয়াত করতে দেখা যায়। সন্তানদের মৃত্যু নিয়ে কারো বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই।
নাহিদ ইসলামের মা রায়না বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমি তারে আগেও বলেছি, বাবা পাখির বাচ্চা ধরতে যাইস না। নাইলে পাখির অভিশাপ লাগবো। তবুও আমার পুয়া (ছেলে) পাখির বাচ্চা ধরতে গেছে। আইজ তুই কইরে বাবা?৪ ভাই ও ৫ বানের মধ্যে ৭ম ও ভাইদের মধ্যে ছোট নিহত নাহিদ ইসলামের বড়ভাই রুহুল ইসলাম সুজন জানান, বেলা আনুমানিক ২টায় তার সাথে ছিলেন একই এলাকার আবিদ ও তাহের। গর্তের কাছে আসার পর কবিরের একটি হাত দেখতে পান। দ্রুত তারা আশপাশের মানুষের সহায়তায় মাটি সরিয়ে নাহিদ ও কবিরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। তাদের সাথেই ছিলো নাহিদ। তার কোন খোঁজ না পেয়ে মাটি সরিয়ে প্রায় এক ঘন্টা পর উদ্ধার করা হয় নাহিদকে। কিন্তু নিকটবর্তী হওয়ায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা হসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার ৩ জনকেই মৃত ঘোষণা করেন। ইসলামনগর গ্রামের লোকজন জানান, ভাটেরা রাবার বাগান কর্তৃপক্ষের যোগ সাজশে একটি সংঘবদ্ধ চক্র রাবার বাগানের মাটি ও বালু পাচারে সক্রিয়। এসব চক্রের কারণেই ৩টি শিশুর প্রাণ অকালেই ঝরে গেলো।
কিন্তু কারা এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত? বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়। এক অজানা আতঙ্ক যেন সবার চোখে মুখে। এনিয়ে ভাটেরা রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
মাটি ও বালু পাচারের বিরুদ্ধে কেউ কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার পাচারকারী চক্র বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে। ভাটেরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বদরুল আলম সিদ্দিকী নানু জানান, এখানকার মাটি ও বালু পাচারের বিরুদ্ধে আগে এলাকার মানুষ আন্দোলন করেছেন। বাগান ও স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি অবগতও করা হয়েছে।
ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম জানান, মাটি ও বালু পাচারের সাথে জড়িতদের কারণেই ৩ শিশুর জীবন গেছে। এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান। তিনি নিহতদের পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন।
ভাটেরা রাবার বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান জানান, মাটি ও বালু তাদের অগোচরে নিয়ে যায় চক্রটি। ১৫ দিন আগে বালুভর্তি একটি পিকআপ ভ্যান আটক করা হয়। কিন্তু স্থানীয় মেম্বার বদরুল ইসলাম পিকআপ ভ্যানটি ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না ? এ প্রশ্নের কোন জবাব দেননি। বিষয়টি ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) নাজমুল হক ভালো বলতে পারবেন।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিম ফরহাদ চৌধুরী জানান, নিহতদের পরিবারকে আরও ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হবে। বালু ও মাটি পাচারকার রোধ কল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে ২৬ মার্চ শনিবার টিলার মাটি চাপা পড়ে ৩ মাদরাসা ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা সবাই ইসলামনগর গ্রামের বাসিন্দা। নিহত নাহিদ আহমদ ও সুমন আহমদ স্থানীয় সাইফুল তাহমিনা আলিম মাদরাসার ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির ছাত্র এবং কবির হোসেন বদরুল নুরুল ইবতেদায়ী মাদরাসার ৩য় শ্রেণির ছাত্র।