পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে কার্যপরিধির কোথাও প্রবেশ ফি আদায়ের কথা উল্লেখ নেই। পর্যটন উন্নয়ন কমিটিকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের ক্ষমতাও দেয়া হয়নি। পর্যটন স্পটে সমৃদ্ধ জেলা সিলেট। এর মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে জাফলং। সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার এই পর্যটন স্পটে প্রবেশ করতে টাকা গুনতে হচ্ছে পর্যটকদের।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের বাইরে গিয়ে জাফলংয়ে প্রবেশ করতে ফি নির্ধারণ করেছে উপজেলা ও জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটি। এটিকে অবৈধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরাও।
উন্মুক্ত নদী ও পাহাড় দেখতে টাকা লাগবে কেন?
এই প্রশ্ন ফি নির্ধারণের শুরু থেকেই। বিশেষত গত বৃহস্পতি বার টিকিট কাউন্টারের কর্মীদের হাতে কয়েক জন পর্যটক মারধরের শিকার হওয়ার পর সেই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে জাফলংয়ে প্রবেশে টিকিট ব্যবস্থা চালুর বৈধতা নিয়ে।
দর্শনার্থীর কাছ থেকে ফি আদায়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু কর্মী নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসন। এই কর্মী নিয়োগের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের নির্ধারিত কার্যপরিধির ৭ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক গঠিত ভলান্টিয়ার গণের কাজের সমন্বয় করবে পর্যটন উন্নয়ন কমিটি। তাদের কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে দেশের জেলা ভিত্তিক পর্যটন উন্নয়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। এর ভিত্তিতেই ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর সিলেট জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির এক সভায় জাফলংয়ে ১০ টাকা প্রবেশ ফি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়।
তবে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপনে পর্যটন উন্নয়ন কমিটির জন্য ১৩টি কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এই কার্যপরিধির কোথাও প্রবেশ ফি আদায়ের কথা উল্লেখ নেই।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রবেশ ফি হিসেবে আদায় করা অর্থ থেকে প্রয়োজনীয় জনবলের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ বহন করা হবে। পাশাপাশি সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
সেই টাকা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট তহবিল গঠনের জন্য একটি ব্যাংক হিসাব খোলার কথাও বলা হয় ওই সভায়। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই প্রবেশ ফি আদায় চালু হয়।
জাফলংয়ে প্রবেশ ফি আদায় ‘অবৈধ’ কর্মপরিধিতে যা ছিল
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপন ঘেঁটে দেখা গেছে, পর্যটন উন্নয়ন কমিটির নির্ধারিত কাজের মধ্যে রয়েছে, জেলার পর্যটন আকর্ষণ চিহ্নিতকরণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ; পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানে পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থানের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষ এলাকা নির্ধারণের প্রয়োজন ও অবকাশ থাকলে সেরূপ এলাকা নির্ধারণের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ; বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণ ও অবস্থানকে নিরাপদ এবং আরামদায়ক করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পর্যটন স্থান গুলোর উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ এবং জেলার পর্যটন উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা আছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ; বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক গঠিত স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের সমন্বয়; উপজেলার পর্যটন উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা তদারকি; বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; পর্যটন উন্নয়ন ও প্রচার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সঙ্গে সমন্বিত ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যটন উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের অন্যান্য নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিশিষ্টজনরা যা বলছেন
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘প্রজ্ঞাপনের কার্যপরিধিতে না থাকা সত্ত্বেও পর্যটন উন্নয়ন কমিটির এভাবে ফি আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত। তারা এটা করতে পারে না। মন্ত্রণালয় নির্ধারিত কর্মপরিধির মধ্যেই তাদের থাকতে হবে।
জাফলংয়ে পর্যটকদের মারধরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে বলা হলো পর্যটকদের বরণে প্রস্তুত সিলেট। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম ?
প্রকাশ্যে পর্যটকদের পেটাচ্ছে প্রশাসনের কর্মীরা। অথচ পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে এগিয়ে আসছে না। ঘটনার সময় পুলিশের কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। এটা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট সবার ব্যর্থতা। এ জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের অন্যতম প্রধান ও সিলেটের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র জাফলং। সেখানেই যদি নিরাপত্তার এই অবস্থা হয় তাহলে অন্য গুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
প্রশাসন যা বলছে
এদিকে পর্যটকদের কাছ থেকে প্রবেশ ফি আদায় অবৈধ নয় বলে বৃহস্পতিবার বলেছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মজিবর রহমান।মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি উল্লেখ করে শুক্রবার তাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমি আসার আগেই চালু করা হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
‘আমি সাতদিনের জন্য ফি বন্ধ রেখেছি। পরবর্তীতে কমিটির সভা ডেকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করব।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাহমিলুর রহমান বলেন, ‘পর্যটকদের সেবার মান বাড়াতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১০ টাকার বিনিময়ে আমরা কয়েকটি সেবা দেই। পর্যটন এলাকায় চেঞ্জ রুম ও টয়লেট করা হয়েছে। পর্যটকরা এগুলো বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারেন। রয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা। পর্যটন এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজও করা হয় এই টাকায়। ’‘টিকিট দেখালে সহজে ও নির্ধারিত মূল্যে ফটোগ্রাফার, ট্যুর গাইড ও নৌকার মাঝি পাওয়া যায়’- যোগ করেন ইউএনও।
প্রবেশ ফির পরিমাণ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেক দিন একেক পরিমাণ টাকা আদায় হয়। ভরা মৌসুমে আমি দিনে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা আদায় হতে দেখেছি।
খরচের খাত হিসেবে তিনি জানান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ পর্যটকদের সেবা দেয়ার জন্য কিছু অস্থায়ী কর্মী রাখা হয়েছে। তাদেরকে ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকা হিসাবে বেতন দেয়া হয়। কর্মীর সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। সর্বনিম্ন পাঁচ-ছয়জন থেকে সর্বোচ্চ ৩০ জন কাজ করেন।
ইউএনও জানান, উপজেলা পর্যটন কমিটি নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। এই অ্যাকাউন্টে প্রবেশ ফি জমা হয়। ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। এখন পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা জমা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ প্রসঙ্গে তাহমিলুর রহমান বলেন, স্বেচ্ছাসেবক বলা হলেও আসলে তারা স্বেচ্ছাসেবক নন। ঘণ্টা-চুক্তিতে তারা কাজ করেন। তাদের কাউকে নিয়োগও দেয়া হয়নি।