১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ অতর্কিতভাবে ইংরেজ আগ্রাসনের শিকার হয় আমাদের মহান মাতৃভূমি সোনার জৈন্তিয়া। ঐ অশুভ দিনে একটি ইংরেজ সৈন্যদল হঠাৎ করে এসে দখল করে নেয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার লীলাভূমি- স্বাধীন জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজধানী। দখলদার ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সিলেটের ইংরেজ সেনাপ্রধান কর্নেল লিস্টারের জামাতা ও সহকারী- ক্যাপ্টেন হ্যারি ইংলিশ। চুনাপাথর ব্যবসার সুবাধে এই হ্যারি ইংলিশ খাসিয়াদের সাথে পরিচিত ছিলেন। জৈন্তিয়ার রাজার সাথে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তাঁর।
হেরী ইংলিশের পিতা জর্জ ইংলিশ ছিলেন একজন সফল পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী। ছাতক বাজারকে চুনাপাথর ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন তিনিই। এই অর্থে তাকে ছাতক বাজারের স্থপতিও বলা যায়। এখনও সেখানে তাঁর সমাধি রয়েছে। এই জর্জ ইংলিশের পুত্র হ্যারি ইংলিশও ছিলেন পিতার মতোই একজন সফল ব্যবসায়ী। সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকলেও পিতার চুনাপাথরের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তিনি। চুনাপাথরের উৎস খাসিয়া পাহাড়ের পলিটিক্যাল এজেন্টও ছিলেন তিনি।
হ্যারি ইংলিশের পিতা জর্জ ইংলিশ ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২০ বছর বয়সে সিলেটে এসে চুনাপাথরের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ ৫৬ বছর সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। তাঁর চুনাপাথরের ব্যবসা যখন সফলতার একদম শিখরে অবস্থান করছে সেই সময়েই তাঁর পুত্র জৈন্তিয়া দখল করেছিলেন। বিনা উস্কানীতে এই রাজ্য দখলের অন্যতম কারণ- জৈন্তিয়ার চুনাপাথর! বলাই বাহুল্য যে, চুনাপাথরের উৎস হল খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশের কোয়ারীগুলো আর এ পাহাড়ের একটি বড় অংশই ছিল জৈন্তিয়া রাজ্যে অবস্থিত।
সিলেটের ইংরেজ রেসিডেন্ট রবার্ট লিন্ডসে সর্বপ্রথম খাসিয়া পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারকে বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। এ পাহাড়ের অ্যালবাস্টার চুনার ভাণ্ডার দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর মন্তব্য ছিল- ‘এখানকার চুনা পাথর দিয়ে সারা বিশ্বের চাহিদা মেটানো যেতে পারে’। তাই এ সম্পদকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে পাহাড়ের পাদদেশের পাড়ুয়া এলাকায় একটি বাণিজ্যকুটি স্থাপন করেছিলেন তিনি।
এরপর এই ব্যবসাকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন জর্জ ইংলিশ ও রেইট। তারা ছাতক বাজারে ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। ক্রমশ আরও পাথর কোয়ারীর সন্ধান মেলে। জৈন্তিয়ার অভ্যন্তরে পাহাড়ী নদী লোভাছড়ার উৎসস্থলে নতুন কোয়ারী আবিষ্কৃত হয়। জৈন্তিয়ার সিংহাসনে তখন রাজা দ্বিতীয় রামসিংহ। লোভাছড়ার পাথর আহরণের জন্য সিলেটের ইংরেজ শাসক ক্যাথার জৈন্তিয়ার রাজা দ্বিতীয় রামসিংহের সাথে চুক্তি করেন। এসব ঘটনা ইংরেজ-বার্মিজ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের।
চুক্তি অনুযায়ী পাথর পরিবহণের জন্য ইংরেজ জাহাজকে জৈন্তিয়ার ভেতর দিয়ে অবাধে চলাচলের সুযোগ দেয়া হয় এবং ইংরেজ এলাকা ও জৈন্তিয়া রাজ্যের মানচিত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। জৈন্তিয়ার একটি এলাকা ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়; বিনিময়ে ইংরেজদের একটি এলাকা জৈন্তিয়ার অন্তর্ভূক্ত হয়। সিলেট শহরের পূর্ব দিকের দক্ষিণকাছ ও ইছাকলস অঞ্চলের বিনিময়ে জৈন্তিয়ার সাতবাক অঞ্চলটি ইংরেজদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাতবাক এলাকাটি বর্তমানে কানাইঘাট উপজেলার দুটি ইউনিয়নে বিভক্ত। ইউনিয়ন দুটি হল- দিঘিরপার পূর্ব ও সাতবাক ইউনিয়ন।
বিনিময় চুক্তির অধীনে ইংরেজদের পাথরের জাহাজ জৈন্তিয়ায় প্রবেশ করতে পারত। সুরমা নদীর শাখা নদী লোভাছড়ার ভেতর দিয়ে ইংরেজ জাহাজ জৈন্তিয়ার ভেতরের পাথর কোয়ারীতে যাতায়াত করত। এছাড়াও এ চুক্তি অনুযায়ী ইংরেজরা আরেকটি সুবিধাও আদায় করে নেয়। জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ইংরেজরা সুরমা নদীর একটি বক্র জায়গা সোজা করে ফেলে। এতে নদীর গতিপথে সামান্য পরিবর্তন আসে। এ জায়গাটি সাতবাকের ভাটি ভারাপইত গ্রামের কাছে অবস্থিত। এখানে সুরমা নদী খুবই বক্রভাবে ‘U’ আকৃতি ধারণ করে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এই জায়গাটি এতোটাই বক্র ছিল যে, তীব্র স্রোতের মধ্যে উজান থেকে কোন জাহাজ এলে এখানে এসে তীরের সাথে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তাই ইংরেজরা নদীর বক্র জায়গাটিতে শর্টকাট গতিপথ তৈরীর পরিকল্পনা করে। জৈন্তিয়ার সাথে তাদের এলাকা বিনিময়ের চুক্তিতে এ বিষয়টিও উল্লিখিত ছিল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসক ক্যাথার তৎকালীন ১৫০০ টাকা খরচ করে এ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। ভাটি বারাপইত গ্রামের মধ্য দিয়ে মাটি কেটে নদীর ‘U’ অংশটির দুই মাথা এক করে ফেলা হয়। এতে সুরমা নদীর প্রবাহ সোজা হয়ে যায় এবং ‘U’ অংশটি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। স্থানীয় ভাষায় এই অংশটির নামকরণ হয় ‘আন্ধু নদী’। ‘আন্ধু’ শব্দের অর্থ হল ‘অপ্রয়োজনীয়’।
জৈন্তিয়া রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী ছিলনা। খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ে প্রাকৃতিক নিরাপত্তা থাকলেও সমতলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী ছিলনা। জৈন্তিয়ার ভেতরে অবাধ চলাচলের সুযোগ পেয়ে ইংরেজরা এ রাজ্যের দূর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা জেনে যায়। তাই তারা রাজ্যটি দখলের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। তাদের এই উৎসাহের মূলে ছিল জৈন্তিয়ার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার! শুধু লোভাছড়া পাথর কোয়ারীই নয়, জৈন্তিয়ার ভেতরে আরও অনেকগুলো পাথর কোয়ারীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল।
এছাড়াও জৈন্তিয়া ছিল বেত, লেবু, তেঁজপাতা এবং বিভিন্ন সাইট্রাস উদ্ভিদসহ বনজ সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার। জৈন্তিয়ার ছোট ছোট পাহাড়গুলোও ছিল চা-পাতা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ইংরেজরা জানত যে, যতদিন জৈন্তিয়া স্বাধীন রাজার অধীনে থাকবে ততদিন তাদেরকে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে। এই রাজস্ব ফাঁকি দিতে হলে জৈন্তিয়া দখল করা ছাড়া তাদের আর কোন পথ ছিল না। কিন্তু ইংরেজরা কখনোই বাণিজ্যিক কারণে রাজ্য দখলের কথা স্বীকার করত না।
ইতিহাস থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক সুবিধার জন্যই ইংরেজরা নবাব সিরাজউদ্দোলার রাজ্য দখল করেছিল। কিন্তু বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তারা নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামে মিথ্যাচার চালিয়েছে। কল্পিত ‘অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের’ জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দায়ী করেছে তারা। একই ব্যাপার ঘটেছে জৈন্তিয়ার