নিউমার্কেট এলাকায় এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিছুদিন পরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ না ঘটলে যেন অস্বাভাবিকই ঠেকে।
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে সাম্প্রতিক সময়ের ‘সেরা’ রণক্ষেত্র দেখল গোটা দেশ। যদিও নানা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এমন রণক্ষেত্র নতুন নয়। আবার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষও নতুন কিছু নয়। বছরে দু তিনবার অবধারিত ভাবে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হবেই। কিন্তু এবারের সংঘর্ষ অভূতপূর্ব। গত রাত থেকে শুরু হয়ে মাঝখানে বিরতি দিয়ে আজকে সকাল থেকে আবারও শুরু হয়। একে তো রোজার দিন, তার ওপরে প্রচণ্ড গরম এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দুপুরও ছাড়িয়ে যায় সংঘর্ষ। অক্লান্ত উদ্যমে লড়ে গেল দুই পক্ষ। তাদের এই ‘বীরত্বপূর্ণ লড়াই’ সংবাদ মাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ‘উপভোগ্য’ হয়ে উঠল। এর মধ্যে দোকানমালিকেরা ‘সত্য সংবাদ’ খবর প্রচার না করার অভিযোগে কয়েকজন সাংবাদিককে ‘প্যাঁদানি’ দিয়েছে, এতে যেন আরও বেশি ‘তৃপ্তিদায়ক’ হয়ে উঠেছে আর কি বিষয়টি।
সংঘর্ষের কারণে রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক মিরপুর রোডে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হলো হাজার হাজার মানুষকে। যদিও বিষয়টি এখন রাজধানীবাসীর জন্য গা সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী–ইবা করার আছে ঢাকাবাসীর! কিছু করার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গ্যাড়াকলের বাইরে কোনো সময় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, কোনো সময় ভিআইপি যাতায়াত, কোনো সময় রাজনৈতিক সম্মেলন, কোনো সময় বিমানবন্দরে সংবর্ধনা, কোনো সময় দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সব মিলিয়ে যানজটের এক ভূস্বর্গই বলা যায় ঢাকাকে। কোনো দিন এসব থেকে একটু ফুরসত পেলেও রক্ষা নেই, সেখানে এমন সংঘর্ষ বা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ঢুকে পড়েই।
বলছিলাম, নিউমার্কেট এলাকায় এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিছুদিন পরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ না ঘটলে যেন অস্বাভাবিকই ঠেকে। এখন পর্যন্ত জানতে পারছি, খাবারের দোকানে ‘ফাউ’ দেওয়াকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটি থেকে এত বড় সংঘর্ষের সূত্রপাত। ছাত্রদের বক্তব্য ভিন্ন। আসল কারণ জানতে সেই এলাকার দুই পরিচিতকে ফোন দিলাম। দুজন দুই পক্ষের। ফলে ভিন্ন ভিন্ন বা পাল্টাপাল্টি বক্তব্যই পাওয়া গেল।
দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সামান্য লিফলেট বিতরণ করায় বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের ‘বিশাল বাহাদুরি’ আমরা দেখতে পাই। দেশের রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নিল, তার ফলস্বরূপ লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলো আর বসে বসে যেন তামাশা উপভোগ করল সরকার, পুলিশ বা প্রশাসন। এ না হলে ‘জাদুর শহর’ ঢাকা!
একজন হচ্ছেন সেখানকার এক মার্কেটের ছোটখাটো ব্যবসায়ী আমিন আলী। মূলত ঈদ এলেই তাঁর ব্যবসা জমজমাট হয়। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত তিনি। আমিন আলীর বক্তব্য হচ্ছে, ‘ভাই, ঢাকা কলেজের ছেলেরা এখানকার দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কী উৎপাত করে তা তো জানেন। এগুলো তো নতুন করে কিছু বলার নয়। খাবারের দোকানে বিল না দিয়ে চলে যাওয়া বা অর্ধেক বিল দেওয়া, জামাকাপড় বা যেকোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও একই আচরণ করে।’ ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী হওয়ার কারণে সম্ভবত আমিন আলী ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ আমরা পাই, তা এড়িয়ে গেলেন।
আরেকজন হচ্ছে ঢাকা কলেজেরই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং পারিবারিকভাবে সেই এলাকারই বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে আমার সেই পরিচিত তরুণ আবার ভিন্ন অভিযোগ জানালেন। তাঁর ক্ষোভ ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়রের প্রতি। তাঁর বক্তব্য, ওই এলাকার এমপি থাকাকালীন নিউমার্কেট এলাকা তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন সিটি মেয়র হওয়ার পরেও সেই নিয়ন্ত্রণ বজায় আছে। ফলে ব্যবসায়ীরাও বেপরোয়া। তাঁর কথা শুনে প্রশ্ন জাগে, মার্কেট এলাকা যার নিয়ন্ত্রণেই থাকুক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেন সংঘর্ষ ঘটতে থাকবে। তাহলে কি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়? ক্লাস-পরীক্ষা ফেলে কেন শিক্ষার্থীরা মার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে যাবে? ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রদের নেতৃত্ব কারা দেন আসলে? ওই এলাকায় যেকোনো সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ থেকে হেলমেট পরা কারা বের হয়? আজকের সংঘর্ষেও ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে হেলমেট পরা দেখা গেছে অনেককে। বিষয়টা এভাবে বললে অমূলক হবে না যে এ সংঘর্ষ মূলত ব্যবসায়ী বনাম ছাত্রলীগের। সেখানে মাঠে নামানো হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরাও ঢাকা কলেজের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি আমরা দেখতে পাই।
অন্যদিকে নিউমার্কটে এলাকার দোকানদার, হকারদের দুর্ব্যবহার, অসদাচরণ ও নারীদের হেনস্তার বিষয়েও কারও অজানা নয়। কেনাকাটা করতে গিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর গায়ে হাত তোলাও নতুন কিছু না।
রাজধানীতে ফুটপাত বাণিজ্য ও হকারদের দৌরাত্ম্যের অন্যতম কেন্দ্র নিউমার্কেট এলাকা। সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রভাব বিস্তারও সেসব হকারদের নিয়ে। সেই এলাকার হকারমুক্ত এক ইঞ্চি ফুটপাত পাওয়া দুষ্করই ঠেকে। ফুটপাতের সেই জায়গা বেচাবিক্রিও হয়। চাঁদাবাজি যা হয়, সেটি অবাক করার মতো। ২০১৬ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণাই বলছে, ঢাকায় বছরে প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা দুই সিটি করপোরেশনের সেই অর্থবছরের সম্মিলিত বাজেটের প্রায় সমান। সেই গবেষণা ধরে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে নিউমার্কেট ফুটপাতে তিন বছর ধরে জুতার ব্যবসা করেন, এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিন ফুট জায়গার জন্য মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। ২০২২ সালে এসে সেই চাঁদাবাজির পরিমাণ নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। সেই চাঁদার বড় অংশ নিউমার্কেট এলাকা থেকে ওঠে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই।
খাবারের দোকানে সামান্য কথা-কাটাকাটি বা মারামারি এত বড় সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার পেছনে ওই এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি আসবেই। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের দুই পক্ষের মধ্যে এ টানাটানি, তাই বুঝি পুলিশও বুঝে উঠতে পারছিল না কার পক্ষ নেবে। আজ সকালে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার তিন-চার ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও পুলিশের দেখা মিলল বেলা একটার পর এসে। অথচ নিউমার্কেট থানা বেশি দূর নয়, বলতে গেলে হাঁটা দূরত্বে। কথা হচ্ছে, বিরোধী দলের কোনো মিছিল মিটিং হলে পুলিশ এতক্ষণ ধরে চুপ মেরে থাকতে পারত? দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সামান্য লিফলেট বিতরণ করায় বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের ‘বিশাল বাহাদুরি’ আমরা দেখতে পাই। একটা দেশের রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নিল, তার ফলস্বরূপ লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলো আর বসে বসে যেন তামাশা উপভোগ করল সরকার, পুলিশ বা প্রশাসন। এ না হলে ‘জাদুর শহর’ ঢাকা!