
সিলেট বিভাগের কোটি মানুষের উন্নত চিকিৎসার ভরসাস্থল এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিদিন হাসপাতালটির নির্ধারিত আসন সংখ্যার প্রায় তিনগুণ রোগীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সেবার ক্ষেত্রে দেশসেরা সরকারি হাসপাতাল হওয়ার সাফল্যও রয়েছে ওসমানীর।
সেবার মান বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে নানা কার্যক্রম চললেও চোর ও দালাল সিন্ডিকেটের কারণে সকল অর্জন যেন ম্লান হতে চলছে। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও যেন পেরে ওঠছে না তাদের সাথে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, রোগীর সাথে অধিক দর্শনার্থী আসায় চোর ও দালালদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এদের দৌরাত্ম্য বন্ধে এবার দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সার্বক্ষণিক গলায় ঝুলিয়ে রাখতে দর্শনার্থীদের জন্য পরিচয়পত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- জানালেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূইঁয়া।
ওসমানী হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, রাত ১০টার দিকে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনের খালি জায়গায় বিছানা করে শুয়ে আছেন শত শত মানুষ। কেউ গভীর নিদ্রায় মগ্ন, আবার কেউ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছিল পুরো হাসপাতাল যেন একটি আবাসিক হোটেল। কথা হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা থেকে আসা রোগীর স্বজন মনোয়ার হোসেনের সাথে।
রাতে হাসপাতালে অবস্থান প্রসঙ্গে জানালেন, তার ভাতিজা গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছে। তাকে নিয়ে পরিবারের চার সদস্য হাসপাতালে এসেছে। হোটেল ভাড়া বাঁচাতে রাতে ওয়ার্ডের বাইরে তারা বিছানা পেতেছেন।
তাদের পাশে থাকা সাজিদ আহমদ নামের আরেক ব্যক্তি জানালেন, তার ছেলের হাতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। দুদিন ধরে তার পরিবারের তিন সদস্য রাত-দিন আছেন হাসপাতালে। দিনে ওয়ার্ডে ঢুকতে হলে গেটম্যানের হাতে ২০ টাকা ধরিয়ে দিতে হয় বলে জানান সাজিদ। সাজিদের কথায় সায় দেন মনোয়ারও।
দিনের বেলা হাসপাতাল ঘুরতে গিয়ে শোনা যায় রোগীদের নানা অভিযোগ। দক্ষিণ সুরমার জালালপুর থেকে অসুস্থ বাবাকে এনে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন জাহেদ আহমদ নামের এক যুবক। ভর্তির পর চিকিৎসকরা কয়েকটি পরীক্ষা লিখে দেন। এরপর এক যুবক এসে দেখা করে জাহেদকে বলেন এই পরীক্ষা গুলো ওসমানীতে হবে না। দ্রুত রিপোর্ট পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা গুলো করায় ওই যুবক। পরে জাহেদ জানতে পারেন পরীক্ষা গুলো নামমাত্র মূল্যে ওসমানীতেই করা যেত।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে (নারী) ভর্তি সাজিয়া আক্তার নামের এক নারীর স্বজনের অভিযোগ তার রোগী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বেডে রাখা মোবাইল ফোন ও ঔষধ গুলো পাননি। দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসারদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।
সিলেট নগরীর শিবগঞ্জের বাসিন্দা শাকিল আহমদ জানান, তার বয়োবৃদ্ধ বাবাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর জন্য হুইল চেয়ার খুঁজছিলেন। হুইল চেয়ারের জন্য এক কর্মচারী টাকা দাবি করলে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি অ্যাম্বুলেন্স থেকে না নামিয়ে তার বাবাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের গেল চার বছরে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম অনেক বেড়েছে। যুক্ত হয়েছে নতুন সেবা। সেবার মান বৃদ্ধির জন্য হাসপাতালের পরিচালক তার টিম নিয়ে দিনের পাশাপাশি রাতেও নিয়মিত হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন। কিন্তু এতো কিছুর পরও দালালদের কারণে কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে না ওসমানী।
এ প্রসঙ্গে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূইঁয়া জানান, হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফরা তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। হাসপাতালের পরিবেশ ও সেবার মান বৃদ্ধির জন্য ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত ও বহিরাগত অ্যাম্বুলেন্স চালকদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়েছে। দালালমুক্ত করতে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে। দালালদের আটক করে মামলা দেয়া হয়েছে। এরপরও কিছু কারণে হাসপাতালকে চোর ও দালালমুক্ত করা যাচ্ছে না।
কেন হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন হাসপাতালে একজন রোগীর সাথে ৫-৬ জন পর্যন্ত দর্শনার্থী আসেন। আইসিইউ বিভাগের সামনে তারা বাসা-বাড়ির মতো পরিবেশ তৈরি করে ফেলেন। ওয়ার্ড গুলোর অবস্থা তো আরও শোচনীয়। নিয়ন্ত্রণহীন দর্শনার্থীদের কারণে চোর ও দালাল সনাক্ত করা কঠিন। দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও পুরোপুরি সুফল মিলেনি। এবার দর্শনার্থীদের জন্য পরিচয়পত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একজন রোগীর বিপরীতে একজন দর্শনার্থী ভেতরে ঢুকতে পারবেন। পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে না রাখলে তাকে জরিমানা করা হবে। এতে সহজে চোর, দালাল ও দুস্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করা যাবে।