
আব্দুস শুক্কুর, গোয়াইনঘাট (সিলেট):
সিলেটের লাখো মানুষের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পাথর কোয়ারিগুলো প্রায় সাত বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকায় গোয়াইনঘাট উপজেলার ব্যবসায়ী ও সাধারণ শ্রমিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তাঁরা। কয়েক বছর ধরে মানুষের কর্মসংস্থানের পথ পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকার ফলে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, লোভাছড়া, শ্রীপুরসহ পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন, সংগ্রহ ও সরবরাহ করে অত্রাঞ্চলসহ দেশের প্রায় কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এই পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকার ফলে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। একই সাথে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক। বর্তমানে ওই শ্রমিকগুলো অনাহারে আর অর্ধাহারে দিনযাপন করছে।
দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় পরিবহন খাত থেকে শুরু করে পাথর লোড-আনলোডের সাথে জড়িত বেলচা ও বারকি শ্রমিক, ট্রাক-ট্রাক্টর ও স্টোন ক্রাশার শ্রমিকদের মাঝেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অধিকাংশ ট্রাক মালিক ব্যাংক ঋণ, আবার কেউ কেউ কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে গাড়ী কিনছিলেন। কিন্তু কোয়ারি বন্ধ থাকার ফলে ট্রাক মালিকরা কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দীর্ঘ সাত বছরের অধিক পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় বেকারত্ব যেন দিনদিন বেড়ে চলছে। আর অসহায় হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। হতাশা যেন পিছু ছাড়ছেনা না তাঁদের। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋন মাথায় নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ছেন।
এছাড়াও কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে বিভিন্ন অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন। দ্রুত পাথর কোয়ারি খুলে দিলে চোরাচালানও অনেকটাই কমে আসবে বলে আশাবাদী।
একাধিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার দাবিতে তারা মানববন্ধন, হরতাল, অবরোধ, পরিবহন ধর্মঘট, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই লক্ষাধিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি জোড়ালো আহ্বান জানান তারা।
পাথর ব্যবসায়ী সাইদুল মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারি বন্ধের ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ছি। ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে এখন জরাজীর্ণ অবস্থা।
জাফলং বল্লাঘাট পাথর উত্তোলন ও সরবরাহ শ্রমিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি সিরাজ মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় আমাদের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের কষ্ট আর যন্ত্রনা দেখার কেউ নেই। মানবেতর জীবন যাপন করছে সিলেটের সবকটি পাথর কোয়ারীর খেটে খাওয়া লাখ লাখ শ্রমিক।
আশা করবো বর্তমান উপদেষ্ঠা শ্রমিকদের কথা বিবেচনায় এনে সনাতন পদ্ধতিতে আবারও সবকটি পাথর কোয়ারী খুলে দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন।
জাফলং-বল্লাঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম পারভেজ বলেন, শ্রমিক অধ্যুষিত জাফলংয়ে বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র কর্মস্থল এই জাফলং পাথর কোয়ারি।
বিগত-২০১৭ সাল হতে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় পাথর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ হাজার হাজার শ্রমিক চরম আর্থিক সংকটে ভোগছেন। পাথর কোয়ারি বন্ধের ফলে অঞ্চলের সাধারণ মানুষ জীবিকানির্বাহ করতে প্রতিনিয়ত সীমান্তপথে পণ্য চোরাচালানসহ নানান ধরনের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শ্রমজীবী এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বিকল্প কর্মস্থান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত জাফলং পাথর কোয়ারি হতে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের উর্ধ্বতন মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে, পাথর কোয়ারি সমুহের উৎসমুখের পাথর অপসারণ না করায় প্রতি বছর ভারতের ঢলে নতুন করে পাথরের স্তুপ জমছে। দিন দিন বেড়ে চলেছে উজান থেকে নেমে আসা এসব পাথরের স্তুপ। এতে করে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে নদ নদীর সাধারণ পানি প্রবাহে দেখা দিচ্ছে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। এতে করে স্থানীয় এসব নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে।
জাফলং-বল্লাঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন খাঁন আনু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় সবকটি কোয়ারিতে বহুগুণ বেড়েছে পাথরের পরিমাণ। তাছাড়া প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলেও উজান থেকে নেমে আসে পাথর। ফলে উৎসমুখে পাথরের স্তুপে নেমে আসা পানি প্রবাহের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব পাথর দ্রুত অপসারণ না করলে এলাকায় নদী ভাঙ্গন প্রকট আকার ধারণ করবে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোয় যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। তবে অপরিকল্পিতভাবে ও যন্ত্রের সাহায্যে পাথর তোলা অব্যাহত থাকায় ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।