" তথ্য সংগ্রহে কাজী স্বাধীন "জেলা নিজস্ব প্রতিনিধি নওগাঁ :
সেই ১৫ নভেম্বর! এই দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সিভিয়ার ব্রেইন স্ট্রোক! হঠাত করেই চার হাত পায়ের জায়গায় হয়ে গেল দুই হাত পা! আজ ৭ বছর পূরণ হল সে অসুস্থতার। এ গল্পটি ফেসবুকে বলা হয়নি কখনো, আজ বলি।
১৫ নভেম্বর ২০১৭। বেলা ২:২০ অফিসে আমার চেয়ারে বসে আছি। ডায়াবেটিস সাথে থাকলেও সুস্থ স্বাভাবিক শারিরিক অবস্থা। চোয়ালে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বসেছি,একটা আঙুল চোয়ালের নিচে গলার উপর অংশ স্পর্শ করেছে। স্পষ্ট অনুভব করলাম সেখানে রক্ত সঞ্চালনের গতি। ব্লাড প্রেসার যে অস্বাভাবিক হাই হয়েছে তা আমলেই নেইনি। আসলে প্রেসার কী জিনিস তা জানতামই না, কোন অসুধও কোনদিন নয়! মনটা একটু চঞ্চল হল, শরীর কি খারাপ লাগছে একটু খানি? বেলা হয়েছে, ক্ষুধার কারণে খানিক খারাপ লাগতে পারে কিন্তু একটু অন্য রকম খারাপ লাগার মত ব্যাপার মনে হল। দশ কদম দূরেই আমার শোবার ঘর কিন্তু যেয়ে শুতে হবে সে রকম খারাপ কিছু না। এই ফেসবুকেই কারো এক পোস্টে পড়েছিলাম স্ট্রোকের শারিরিক লক্ষ্মণ বিষয়ে। মিলিয়ে দেখতে যেয়ে দেখি মিলছে একটু করে। দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ বিভ্রম! টেবিলের উপর ছড়ানো হাত নিজের দিকে টানতে যেয়ে দেখলাম কিছুটা আড়ষ্ট!
দরজার পর্দা একটু করে দুলছে যখন, তখন দেখতে পাচ্ছি এক রুম পরের রুমে কোন এক ম্যামের আঁচল, পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাস নিচ্ছেন, তাঁকে ডাকলাম বেশ স্বাভাবিক স্বরেই, তিনি তৎক্ষণাৎ পর্দা সরিয়ে অফিসে ঢুকে সালাম জানিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন; কিছু দরকার স্যার? চেয়ারে বসুন, সম্ভবত আমার স্ট্রোক হতে চলেছে, কথাটুকু শুনে তিনি ভূত দেখার চেয়ে চমকে গেলেন! কী বলবেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না, অস্থির ও অসহায় ভঙিতে দাঁড়িয়ে রইলেন চেয়ার ছেড়ে।
আপনি কাছাকাছি থেকে একটু নজর রাখুন, আমি যেন চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে না যাই, স্ট্রোক হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
এটুক শুনার পর তিনি আপসেট এবং ভিষণ নার্ভাস হয়ে গেলেন। আমি টেবিলে ছড়ানো হাত দুখানি সোজা উপরে জাগাতে যেয়ে ব্যার্থ হলাম এবং টেবিলের নিচে ভাঁজ করে রাখা একটা পা সটান হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি ম্যামকে বললাম, এক্ষুনি আমার স্ট্রোক হয়ে গেল, আমাকে হাসপাতালে নিন। এবার তিনি আরো অসহায় হয়ে পড়লেন, ভালো একটি মানুষ চোখের সামনে রোগী হয়ে গেল! আমার বাম হাত আর বাম পা তখন অকেজো! ডান হাত দিয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ানোর এটেম্পট নিলাম। পুরো পুরি ব্যার্থ। জ্ঞান আছে টনটনে, মনোবলও আছে বেশ, আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম কোন মতে টেবিলে হেলান দেয়ার মত করে বাঁকা হয়ে আংশিক দাঁড়াতে পারলাম। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম দেরি না করে এক্ষুণি হাসপাতালে যেতে হবে। আমার মেয়ে সে সময় এসে দরজায় দাঁড়ালো, বাবা, আপনার মুখ বাঁকা কেন? বাঁকা মুখেই বলতে থাকলাম, কোন দেরি না করে হাসপাতালে চলো। ম্যাম আর মেয়ে ধরে অফিসের বাহিরে আসতে সাহায্য করল। শক্ত করে ওদের ধরে চলছিলাম কিন্তু বাম পা ছিঁচড়ে চলছিল, শরীর তো পুরো টলমলে তখন, তবু ওদের সহায়তায় স্কুল ভবনের সাথে লাগানো রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এখন একটা রিক্সা বা টমটম পেতে হবে। খাড়া দুপুরে মোড়ে কোন বাহনই দেখা গেল না। ততক্ষণে আড়াইটা বেজে গেছে, স্কুল ছুটি হয়েছে, বাচ্চারা চলে গেছে। আমাকে দাঁড় করিয়ে ওরা কিং কর্তব্য বিমূঢ়! তখনও আমার টনটনে জ্ঞান। বললাম ফাইবের ছেলেদের কাউকে পাঠান মসজিদের আশেপাশে দুএকটা টমটম ওখানে দাঁড়াত দেখি প্রায়ই, ডেকে আনুক। দুটো ছেলে দৌড়ে গিয়ে একটা টমটম নিয়ে এলো। ধরাধরি করে টমটমে উঠে বসেছি, কিন্তু বসে থাকতে পারছি না, এক দিকে টলে কাত হয়ে যাচ্ছি। মেয়ে আমার ধরে সামলাতে পারছে না ঠিকমত, থেমে থাকা অবস্থাতেই এই হাল, টমটম চলতে শুরু করলে কী হবে! আমি রোগী কিন্তু আমিই ওদের ডিক্টেক্ট করছি। বললাম, কেবল ছুটি হয়েছে দুজন স্যার এখনো বেশি দূর সাইকেল হাঁকাতে পারেনি, ওদের কাউকে ফোন দেন। ফোন পেয়ে সাথে সাথেই দুজন এসে খাড়া, ওরা পাশে বসে আমাকে শক্তমত জাপটে ধরে থাকলো। টমটম এসে দাঁড়ালো সদর হাসপাতালে।স্ট্রেচারে শুইয়ে কড়িডোরে এনে রাখা হয়েছে আমাকে। মনে পড়ল স্নেহের ছোট ভাই রূপান্তর সম্পাদক তরুণ রবিউল মাহমুদের কথা। সে তো হাসপাতালে চাকরি করে পার্টটাইম। ফোন পেয়ে ব্যাস্ত হল ফোনের ওপারে। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি তুমি একটু আসো, এ হাসপাতালে তো স্ট্রোক পেশেন্টের চিকিৎসা নাই, হয় মরে, না হয় জব, রেফার্ড টু রাজশাহী মেডিকেল। ও বলল, চিন্তা করেন না ভাই, আপনার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে! চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ দেখলাম এবং একটু পরেই শুনতে পেলাম রাজশাহী তে যেতে হবে। ঢাকা থেকে ডাক্তার ভাতিজা বলল রাজশাহী না নিয়ে বগুড়া জিয়া মেডিকেলে নিতে, আলটিমেটলি ঢাকাতে নিউরো সাইন্সেই নিতে হবে, তাহলে রাজশাহীর উল্টো পথে কেন? এর মধ্যে কাছের মানুষ জন এসে জড়ো হয়েছেন সদরে, তারা দরকারি পরামর্শ করে নিলেন। এমবুলেন্স ছাড়লো জিয়ার পথে।
এখানে কোন চিকিৎসা নয়, সিটি স্ক্যান হল। ফটো দেখে জিয়া স্তম্ভিত! এ রোগী এখনো বেঁচে আছে? বিকেল পার হচ্ছিল তখন, ঢাকা যেতে হবে, তাই তাড়া ছিল আমাদের কাফেলায়। জিয়ার মনোভাব তখন এমন যে এ রোগীকে অতদূর টেনে কী লাভ? অত দূর পর্যন্ত এ হয়তো টিকবেই না! তাদের ফিসফাস আমার কানেও আসছিল কম বেশি। মরে যেতে চলেছি এটা মাথায় ঢুকে গেল! জ্ঞান হারাইনি তখনো, ডাক্তার ভাতিজার পরামর্শে শেষ পর্যন্ত এম্বুলেন্স ঢাকার পানে মুখ ফিরালো। শরিরের কোথাও কোন ব্যাথা বা যন্ত্রণা টের পাচ্ছিলাম না, শুধু বাম কপালের উপর দিকে নাম না জানা, অচেনা এক ধারাবাহিক হাল্কা চিনচিনে ব্যাথা লাগে। এম্বুলেন্সে আমার মাথা কোলে নিয়ে আমার স্ত্রী বসে। তিনি কপালের উপরে ঐ ব্যাথার অংশে আঙুলের আলতো পরশ দিয়ে চলেছেন। চোখে তার হতাশা, দূরাশা, এই অল্প বয়সে বিধবা হতে চলেছেন এমন অব্যক্ত আকুতি তার চোখে স্পষ্ট!
রাস্তাঘাট কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু কেমনে কেমনে মোটামুটি ঠিকঠাক অনুমান করে চলেছি আর থেকে থেকে বলছি এখন এখানে? ওখানে? ঢাকার ভিতরে ঢুকে তখন রাত হলেও বুঝতে পারছিলাম অনেকটা। এক জায়গায় তো জোড়ে গলা বড় করে বলতে শুরু করলাম এখানে কোথাও দাঁড়াও, সাদী উঠবে এখান থেকে। সহযাত্রী সকলে অবাক! তাদেরই মনে নাই বনানী থেকে সাদীকে পিক করার কথা হয়েছিল অথচ আমি ঠিকঠাক মনে রেখে যথাস্থানে যথা সময়ে বলে ফেললাম। যােহোক, সাদী উঠল। তারপর জ্যামজুম পেরিয়ে নিউরো সাইন্সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আড়াইটা!
করিডোরে হাই স্ট্রেচারে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। জায়গামত নিরাপদে পৌঁছাতে পারায় সহযাত্রীরা কিছুটা রিলাক্সড। তারা এখানে ওখানে ছড়ানো সোফায় গা এলিয়ে দিছে। আমাকে ছেঁকে ধরেছে রাজ্যের মশা। এক হাত নেড়েনুড়ে তেমন সুবিধা করতে পারছিলাম না। শংকাটা হল, তখন চিকনগুনিয়ার প্রকোপ বেড়েছে! কিছুক্ষণ বাদে কয়েকজন নার্স সহযোগে ডাক্তাররা এসে আমার স্ট্রেচার ঘিরে দাঁড়ালেন।
এখানে রোগী কে?
কারো কোন রেসপন্স নাই, আমি ডান হাতটা একটু উঁচিয়ে বললাম, আমি। ডাক্তার এবার আমার দিকে ফিরলেন। কী নাম?
- কাজী রাহাত
কোথা থেকে এসেছেন, ঠিকানা বলতে পারবেন?
- জী পারব। নওগাঁ সদর। মোবাইল নাম্বার লাগবে?
ডাক্তার এবার অনেকটা ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। নাম্বার বলতে পারবেন? আপনার নাম্বার মনে আছে?
জী আছে। ০১৭১১৫৮৭৫৬০। কল দিলে ফোন বাজবে, ফোন আমার পকেটে আছে। ডাক্তার ফোন দিলেন না কিন্তু যা বুঝার বুঝে নিলেন। আমি এবার গলা ঝেরে কিছুটা চড়িয়ে বললাম
এহ্ অনেক মশা এখানে। আমাকে এখান থেকে সরান, নাহলে চিকনগুনিয়া ধরে ফেললে দুই কেস এক সাথে সামলাতে পারবেন না! ডাক্তার আবার ফিরলেন আমার দিকে, চমৎকার লজিক! এরই মধ্যে সহযাত্রীরা সকলে এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তার বললেন এ রোগী তো মোবাইল নাম্বার বলতে পারে, তার মানে স্মৃতি অটুট। আবার লজিকও টনটনে, এর চিকিৎসা এখানে হবে না, আরো সিরিয়াস রোগীকে আমরা কাটা ছেঁড়া করি, এই ভাল মাথা আমরা কাটতে যাব কেন?
সোরেফার্ড টু সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল।
সোহরাওয়ার্দীতে ভর্তি হবার পর প্রথম জ্ঞান হারায়ে ফেললাম!