বাড়িবাংলাদেশেনতুন রূপে সিলেট: রূপান্তরে আশার আলো বাড়ছে পর্যটন সম্ভাবনার

নতুন রূপে সিলেট: রূপান্তরে আশার আলো বাড়ছে পর্যটন সম্ভাবনার

পাহাড়-টিলা, ঝরনা-ছড়া, হাওর-বাঁওড় আর সবুজের প্রাচুর্যে ভরা সিলেট। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এ বিভাগে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষা পাথুরে নদী, বন, চা-বাগান; কী নেই এখানে। বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসেন পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সারা বছরই পর্যটনকেন্দ্রে থাকে উপচে পড়া ভিড়। তবে কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) পরিস্থিতিতে অন্তত পাঁচ মাসের জন্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল পর্যটন খাত। অথচ বাংলাদেশের দ্রতবর্ধনশীল পর্যটন মার্কেটের মধ্যে সিলেট অন্যতম। তবে আশার কথা হচ্ছে, কয়েক মাস ধরে আবারও দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন। ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব বলেন, সিলেটে পর্যটন কেন্দ্রিক দুটি বিষয় রয়েছে। একটি ধর্মীয় ট্যুরিজম, অন্যটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেন্দ্রিক ট্যুরিজম। এ দুটি কারণে দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ সিলেটে আসেন। তবে কোভিডের কারণে গত বছরের মার্চের শেষ দিক থেকে পর্যটন কেন্দ্র গুলো ফাঁকা হতে থাকে। পরে সরকারি নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। লকডাউনের পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। মানুষজনও দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকার পর মানসিক অবসাদ দূর করতে আবার প্রকৃতির কাছাকাছি আসতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় আগের মতো না হলেও আবার পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছে।
আবু তাহের মো. শোয়েব আরও বলেন, করোনা ভাইরাস-পূর্ববর্তী সময়ে কেবল সিলেট জেলাতেই পর্যটনকেন্দ্রিক খাতে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা আয় হতো। সিলেট বিভাগের অপর তিন জেলা—মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের হিসাব ধরলে সে আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হবে বলে তাঁদের ধারণা। পর্যটন খাতটি বৃহত্তর সিলেটের ব্যবসায়ীদের জন্য অপার সম্ভাবনার খাত হলেও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি সবাইকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। এখন যেহেতু পর্যটকেরা আবার ভ্রমণে আসছেন, তাই পর্যটন-সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের মনে আশা জেগেছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে টানা পাঁচ মাসের বেশি পর্যটকশূন্য ছিল কেন্দ্রগুলো। এ কারণে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কয়েক মাস ধরে মানুষজন আবারও পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে আসছেন। পর্যটকদের আগমনে সিলেট জেলার কেন্দ্রগুলো মুখর হওয়ায় পর্যটন ব্যবসাও চাঙা হতে শুরু করেছে।
সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র গুলোর মধ্যে সম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি পর্যটককে ভিড় করতে দেখা গেছে কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, রাতারগুল, মায়াবী ঝরনা ও জাফলং, জৈন্তাপুরের লালাখাল, শাপলা বিল, রাজবাড়ি ও শ্রীপুর, ফেঞ্চুগঞ্জে হাকালুকি হাওর এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ায়। বিশেষত শুক্র ও শনিবার পর্যটকের ভিড়ে এসব স্থান মুখর হয়ে উঠছে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চলতি মাসের শুরু থেকে পর্যটকের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে দলে এসে পর্যটকেরা ভিড় করছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট মন্দার ক্ষতি কাটিয়ে লাভজনক হবে জেলার পর্যটন ব্যবসা।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালে বন্ধ ছিল আবাসিক হোটেল-রেস্তোরাঁ। পরে লকডাউন উঠে গেলেও পর্যটকেরা না আসায় এ দুটি খাতের ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায় দিন যাপন করেছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য না ফিরলেও এখন পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। ফলে আবাসিক হোটেল আর রেস্তোরাঁয় ব্যবসাও ক্রমশ জমজমাট হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখা জানিয়েছে, সিলেট নগরে প্রায় সাড়ে ৩০০ এবং জেলায় ৭০০ রেস্তোরাঁ রয়েছে। এসব রেস্তোরাঁয় ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ থাকায় অনেকেই কাজ হারিয়েছিলেন। তবে এখন রেস্তোরাঁ গুলো আবার জমজমাট হতে শুরু করেছে। কাজ হারানো শ্রমিকেরাও কাজে ফিরেছেন।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, আগে গ্রুপ ট্যুরে অনেকেই সিলেটে আসতেন। এটা এখন কমে গেছে। অনেকে আগে ছুটি পেলেই দুই থেকে তিন দিন থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে বেড়াতে আসতেন। এখন ডেইলি বেইজড ট্যুর বেড়ে গেছে। ফলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা আগে যাঁদের কাছ থেকে তিন দিন নানা ধরনের ব্যবসা করতে পারতেন, এখন সেটা এক দিনে নেমেছে। করোনা পরিস্থিতির কারণেই এমন হয়েছে। এরপরও কিছু কিছু পর্যটক যে আসছেন, সেটাই মন্দ কী?
নগরের কয়েকটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা গেছে, কয়েক মাস আগেও দুপুর কিংবা রাতের মতো ব্যস্ত সময়ে আসন ফাঁকা থাকলে এখন মানুষের ভিড়। সিলেটে পর্যটক এলে যে কয়েকটি রেস্টুরেন্টে বেশি খেতে যান, এর মধ্যে জিন্দাবাজার এলাকার পানসী রেস্টুরেন্ট অন্যতম। এ রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আহমদ বলেন, ‘এখন আগের তুলনায় পর্যটক অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কম আসছেন। তবে পর্যটক যে সীমিত পরিসরে হলেও আসছেন, এতেই আমরা খুশি।’
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) এর মাজার এবং শ্রী শ্রী চৈতন্য দেবের পৈতৃক ভিটা সিলেটে হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ সিলেটে আসেন। এ সময় সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট গুলো জমজমাট থাকত। একই সঙ্গে রেস্তোরাঁ ব্যবসাও ভালো হতো। করোনা কালে এসব ব্যবসায় ধস নেমেছে। এ ছাড়া সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রের অনেক গুলোতে নৌকায় করে যেতে হয়। পর্যটক না আসায় এসব পর্যটন কেন্দ্রিক কয়েক হাজার নৌ শ্রমিককে দীর্ঘদিন বেকার হয়ে অমানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে।
একই সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের চার জেলায় শতাধিক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এসব পর্যটন কেন্দ্রে বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ পর্যটক আসেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আসেন ১২ থেকে ১৩ লাখ। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে প্রায় ৫ লাখ করে ১০ লাখ এবং হবিগঞ্জে প্রায় ২ লাখ পর্যটক আসেন। তবে করোনা পরিস্থিতির পর গ্রুপ ও করপোরেট ট্যুর কমে গেছে। তবে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ট্যুর আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। এর ফলে আগের মতো না হলেও পর্যটকদের কেনাকাটার তালিকায় থাকা মণিপুরি পোশাক, চা-পাতা, সাতকরাসহ স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বেচাকেনাও কিছুটা বেড়েছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক ও হোটেল সিলেট ইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুকির হোসেন চৌধুরী জানান, সিলেট নগরে দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর বাইরে শহরতলি ও পর্যটনকেন্দ্রিক কিছু উপজেলায় বেশ কিছু রিসোর্ট রয়েছে। গত বছরের ২৬ মার্চের পর থেকে কমবেশি পাঁচ থেকে ছয় মাস হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ ছিল। এরপর এসব চালু হলেও মানুষজন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা আসতেন না। তবে কয়েক মাস ধরে আবার পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পর্যটন ব্যবসার মন্দা কেটে যাবে বলে তাঁরা আশাবাদী।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments