
মো: আকতারুজ্জামান কাজল,উপজেলা প্রতিনিধি বোদা, পঞ্চগড় ।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ঝলঝলি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুব উল আলমের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য সহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এখন দিনের আলোর মতই পরিস্কার স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও এলাকাবাসীদের মধ্যে। তবে, অভিভাবক সহ এলাকাবাসীদের অভিযোগ, এতসব অনিয়ম সামনে আসার পর, তাদের প্রতিবাদের মুখেও ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় ও অদৃশ্য শক্তি বলে এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। বরং ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করার পরও চলছে পুরো নিয়োগ প্রকৃয়া বৈধ বলে চালানোর চেষ্টা।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অভিভাবকদের সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক মাহবুব। যাদের মধ্যে ৩ জন ২০২২ সালে এবং সর্বশেষ একজনকে ৩১ জুলাই, ২০২৪ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ দেবার সময় স্কুলটির উন্নয়নের কথা বলে এদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের (সর্বমোট প্রায় ৫৪ লক্ষ) টাকা। তবে, সে টাকা স্কুলের উন্নয়নে নয়, স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে ব্যায় করেছেন নিজেদের উন্নয়নে। যার মধ্যে গত ৩১ জুলাই ২০২৪ ইং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মো. জায়েদ হাসানকে যোগদান করান। নিয়োগ দেবার শর্তে তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিলো সারে আট লক্ষ টাকা। ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী জায়েদকে এসব ঘাটতে গিয়েই বেরিয়ে আসে আরো অনেক গোপন তথ্য।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে প্রধান শিক্ষক মাহবুব উল-আলম এক লিখিত অভিযোগ জমা দেন। যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, প্রধান শিক্ষক মাহবুব উল আলমের অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা থেকে তাকে বিরত রাখা হয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে দেখতে গেলে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন প্রধান শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
সে অভিযোগে আরও বলা হয়েছিলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ১২ আগস্ট বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলে, সহকারী প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল ইসলাম, সহ: শিক্ষক সাইফুল ইসলাম, সহ:শিক্ষক নুরুজ্জামান ও স্থানীয় এলাকাবাসীরা সহ প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষ তালাবদ্ধ রাখেন এবং তার কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
সহ:প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল ইসলাম, শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও শিক্ষক নুরুজ্জামান,ও স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল, নুর ইসলাম বলেন, ১৭ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে মামলা হামলার ভয়ে আমরা কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি। কিন্তু এখন দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। দেশের সব সেক্টরে সংস্কার চলছে। তাই আমরা চাই সব অনিয়মের বিচার হোক। স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী মিলে আমরা এই দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এত পুরনো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের জন্য নেই কোন ওয়াশরুম, টিনের চালাগুলো অনেক জায়গায় ফুটো, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরন ও আসবাব, স্কুলের শহীদ মিনারটিরও অবস্থা জরাজীর্ণ। প্রধান শিক্ষকের কাছে এসবের কৈফিয়ৎ চাইতে গেলে সেসময় অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে তার রুমে তালা দেওয়া হয়, এরপরে তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলে তার কাছে আয় ব্যয়ের হিসাব চাওয়াতে প্রধান শিক্ষক ইউএনওর কাছে আমাদের নামে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির মিথ্যে অভিযোগ করেন।
তারা আরো জানান, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের পরিবর্তে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। বিদ্যালয়ের একটি পুকুর ও জমি ইজারা দিয়ে প্রধান শিক্ষক ২ লাখ টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি করেন, ঝলঝলি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুব-উল আলম ও বোদা উপজেলা আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি মশিউর রহমান মানিক (বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি) মিলে নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। প্রধান শিক্ষক উপজেলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় দলীয় প্রভাব বিস্তার করে বিদ্যালয়ের ৩ জন কর্মচারীকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এবং ১ জনকে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জুলাই এর নিয়োগপ্রাপ্ত জায়েদ হাসানের বাবা মোঃ রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, ২০২২ সালে আমার বড়ো ছেলের বৌ অর্থাৎ আমার বৌমাকে নিয়োগ দেওয়া কথা ছিলো। সে সময় সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক অগনিত টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল যা আমার হিসাবের বাইরে ছিল। আমি বোদা মেডিকেল মোড়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম তাদের সামনে। সে সময় প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতি আমার কাছে আরো ২লাখ ৫০ হাজার টাকা চায় এবং বলে যে তোমার ছেলে জায়েদকে এখানে নিয়োগ দিবেন। পরবর্তীতে আমি টাকা সংগ্রহ করে একটা পরিবেশ তৈরি করে মেডিকেল মোড়ে টাকা নেন প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতি।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মাহবুব উল আলম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তিনি সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে প্রধান শিক্ষকের পদে কার্যত ‘কাঠের পুতুল’ ছিলেন। তিনি বলেন, “নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সভাপতির অনুমোদন ছিল চূড়ান্ত। আমি শুধু সেই নির্দেশ অনুসরণ করেছি। যতগুলো নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে সবগুলোই সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও সভাপতির সুপারিশে নিয়োগ প্রাপ্ত।
তবে, মশিউর রহমান মানিক এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “নিয়োগ বাণিজ্য হলে তার জন্য আমি দায়ী নই। প্রধান শিক্ষকের ওপর নিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করত, আর আমার কাজ ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখা।”
উপজেলা জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ আইবুল ইসলাম বলেন, নিয়োগ বাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুর্নীতিবাজ এ প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরুদ্ধে ওঠা নিয়োগ বাণিজ্য সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রশাসনের কাছে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন স্কুলটির শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসীরা।