প্রিন্ট এর তারিখঃ মার্চ ১৩, ২০২৫, ১:৩৫ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১১, ২০২৫, ১০:২২ এ.এম

মোঃআবু হানিফ উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
"শখের তোলা আশি টাকা” প্রবাদটির বাস্তব উদাহরণে ছিলেন সিরাজগঞ্জের মৃত দেলোয়ার হোসেন মিঞা।তৎকালিন সময়ে তাঁর শখ পূরণের গল্প যেমন ব্যতিক্রমী,তেমনি আবার মর্মস্পর্শী।
ঘটনাটি কিন্ত আজকালের নয়, ১৯৬৫ সালের। সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার রামকৃঞপুর ইউনিয়নের রহিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন দেলোয়ার হোসেন মিঞা।যিনি পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে তখনকার সময়ে একটি রেডিও কিনছিলেন,আর ব্যাটারি কেনার জন্য বিক্রি করেছিলেন আরও এক বিঘা জমি!
শখ পূরণে মানুষ কতকিছুই তো করে, কিন্তু এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল।এর জন্য অবশ্য পরবর্তীতে দেলোয়ার মিঞাকে অনেক কষ্টও করতে হয়েছে। অভাবের তাড়নায় সাত বছরের মাথায় আবার শখের সেই রেডিও বিক্রিও করেছিলেন তিনি। তার আগে বিক্রি করেছেন নিজের ঠাঁই বসতবাড়ি।
তাঁরই ছেলে সদা হাস্যোজ্বল,সলঙ্গার সবার প্রিয়,ফোক সম্রাট হিসেবে পরিচিত সেই আলতাফ হোসেন বাবার স্মৃতি হিসেবে ৫০ বছর পরে ২০২২ সালে সেই রেডিও আবার বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
অর্ধ শতাব্দীর বেশি পুরোনো রেডিও দেখতে তখন অনেকে ভিড় করছেন আলতাফ হোসেনের বাড়িতে।কিন্তু তিনি রেডিও বাজাতে পারছিলেন না।কারন রেডিওটি চালু করতে একসঙ্গে আটটা ব্যাটারি লাগে।এর দামও প্রায় ৪০০ টাকা।কিন্তু ওই টাকা খরচের সামর্থ্যও নেই আলতাফের।কারণ, শখের মূল্য দিতে গিয়ে মৃত বাবা তাঁদের নিঃস্ব করে গেছেন। রেডিওটার গায়ে লেখা আছে নিপ্পন ইলেকট্রনিক কোম্পানি লিমিটেড, জাপান।
বাবার সেই কাহিনী বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠে আলতাফের।তাঁর বয়স এখন প্রায় সত্তর বছর।শুনেছি,তিনি মানুষের বাড়িতে রাখালের কাজ করতেন।
আলতাফ হোসেন বলেন,আমার মৃত বাবার শখের শেষ ছিল না।এলাকার মানুষ যা চাইতেন, বাবা তাই দিতেন। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে একসময় পৈতৃক ২৬ বিঘা জমি শেষ হয়ে গেছে।১৯৭২ সালে রেডিওটাও ১৮০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আলতাফ আরও বলেন,বাবা রেডিও বিক্রির সময় আমি চিক্কর দিয়া উঠলাম। কইলাম বাবা,জমিও গেল,রেডিও গেল! বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কইলেন,আবার কিনে দিব।’
রেডিও বিক্রির আগে আলতাফ হোসেনের বাবা ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়িও বিক্রি করেন।২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। কয়েক বছর আগে শুনেছিলাম, আলতাফ পাশের বনবাড়িয়া গ্রামের রহমান মাস্টারের বাড়িতে রাখালের কাজ করেন।তাতেও তাঁর কোনো দুঃখ নেই।তাঁর মন পড়ে থাকে রেডিও'র কাছে। স্থানীয় জিল্লার খন্দকার নামের এক ব্যক্তি রেডিওটি কিনেছিলেন।তিনি দিনে দু'বার করে তাঁর বাড়িতে রেডিওটা নিতে যান।কিছুতেই তাঁরা দিতে চান না। ২০১০ সালে জিল্লার খন্দকার মারা গেলে রেডিওটা তাঁর ছেলে আমজাদের কাছে ছিল।তাঁর কাছে গেলে তিনি বলতেন,বাবা মারা যাওয়ার আগে কোথায় রেখে গেছে জানেন না।তবু হাল ছাড়েন না আলতাফ। তাঁর এই রেডিও প্রীতি দেখে ২০১৪ সালে উল্লাপাড়া উপজেলার পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান মারুফ বিন হাবিব এক ব্যাটারির ছোট একটা রেডিও কিনে দেন গান প্রেমিক আলতাফকে।
পাশের চেংটিয়া গ্রামের নির্মাণ শ্রমিকের সহকারী হাবিবুর রহমান শেখ পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে রেডিও কেনার বিষয়টিও জানেন। তাঁর ভাষ্যমতে,তখন তাঁর পুরো জ্ঞান হয়েছে।আলতাফ হোসেনের বাবা রেডিও কিনে আনলেন।গ্রামের শত শত মানুষ এসে সেই রেডিওতে ভাষণ শুনছেন,গান বাজনা শুনছেন—এসব তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।
২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি সকাল সাতটায় ৫০০ টাকার একটা নোট নিয়ে তিনি আমজাদের কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলেন, রেডিওটা ফেরত দিন, এটা আমার মৃত বাবার শখের জিনিস ছিল।এ কথা শুনে টাকা ছাড়াই আমজাদ তাঁর হাতে রেডিওটি তুলে দেন।আলতাফ হোসেন বলেন,পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি রাখালি করছেন।সারা জীবন শুধুই কষ্ট।এ জন্য বিয়ে করতেও দেরি হয়েছে।মেয়েটা ৩ বছর আগে এইচএসসি পাস করেছে।ছেলেটা ছোট।তখনও রাখালিই করেছেন। সংসারই চলে না। বাবার রেডিও'র সেই আওয়াজ ভুলতে পারেন না।মন চায় রেডিওটা বাজাতে। আটটা ব্যাটারির দাম এখন ৪০০ টাকা। বিদ্যুৎ সংযোগে শুনবেন,তার জন্য মিস্ত্রির কাছে নিতে হবে।সে সামর্থ্যও যে তাঁর নেই।বলতে বলতে আলতাফ হোসেন রেডিওটা বুকের কাছে ধরেন। তাঁর চোখ ভিজে ওঠে।এভাবেই এখনও তার মৃত বাবার স্মৃতি বিলুপ্ত প্রায় "রেডিও" বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছেন আলতাফ।