
নিজস্ব প্রতিবেদক,নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
বাংলাদেশে শচীন্দ্রলাল সরকারের মত এমন মহৎ ও গুনীজন ব্যক্তিরা সবসময় জন্মগ্রহণ করেন না, অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর।ব্যক্তিজীবনে নি:সন্তান হলেও অগণিত ছাত্র/ছাত্রী ও সৃষ্টিশীল কর্মের মাঝে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।বাংলাদেশের এই ক্ষণাজন্মা মানুষটি আজকের এই দিনে ২০২০খ্রিষ্টাব্দের ২২মে হবিগঞ্জ সদরে নিজ বাসায় বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ চতুর্থ প্রয়াণদিবসে (২২মে)এই গুনী মানুষটিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
ছোট বেলা থেকেই শচীন্দ্রলাল সরকার মেধাবী ছিলেন। হিন্দু ধর্মীয় পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পান। দেশ ভাগের ফলে তার পরিবারের সঙ্গে তাকে কলকাতায় চলে যেতে হয়। পরে আবার দেশে ফিরে আসেন। লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের অভাব অনটনের কারণে আর হয়ে উঠেনি।সংসারের হাল ধরতে হবিগঞ্জ শহরের ঘাটিয়া বাজার এলাকায় সুলভ বস্ত্রালায় (নয়া হাজারী) সাধারণ কর্মচারী হিসেবে চাকরি নেন। দীর্ঘ দিন চাকরির সুবাধে নিজেকে একজন দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলেন।সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পরে নিজেই ঘাটিয়া বাজারে একটি ছোট্ট কাপড়ের দোকান খোলেন।দারিদ্র্যের কারনে তিনি বেশি দূর পড়াশোনা করতে না পারলেও কাপড়ের দোকানে কর্মচারী থেকেও সততা ও বিশ্বস্ততা দিয়ে সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজেকে সফল ব্যবসায়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
শচীন্দ্রলাল সরকার ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০জুন হবিগঞ্জ জেলা সদরে ঘাটিয়া বাজার এলাকায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবা সদয় চাঁদ সরকার ও মাতা নীরদাময়ী সরকার।হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া সিংহগ্রাম ও তার আশেপাশের গ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিজয়লক্ষ্মী জুনিয়র হাই স্কুল যা পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়।প্রতিষ্ঠানটি হওয়ার পর থেকেই নাসিরনগরে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে এক আমূল পরিবর্তন।এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে শতশত ছেলে মেয়ে আজ বিভিন্ন কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।কেউ সরকারি অফিসে চাকুরী করছে কেউবা আবার বেসরকারি অফিসে চাকুরি করছে।
শচীন্দ্রলাল সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে তিনি নিজ অর্থায়নে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সর্বপ্রথম ১৯৮৪ সালে হবিগঞ্জ শহরে নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন নীরদাময়ী স্কুল।তারপর তিনি ১৯৯৮সালে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় নাগুড়া এলাকায় ছয় একর ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেন শচীন্দ্রলাল ডিগ্রি কলেজ।যে কলেজটিতে দুতলা বিশিষ্ট ভবন, সুরমা উদ্যান, বিজয়লক্ষ্মী সরোবর, ছাত্রাবাস এবং মসজিদও নির্মাণ করেন।
তিনি১৯৯২ সালে হবিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে শচীন্দ্র লাল সরকার নামে শিক্ষা বৃত্তি চালু করেন। এছাড়া ১৯৯৯ সালে শচীন্দ্র কলেজের পাশে শ্রী চৈতন্য সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয়, ১৯৯৮ সালে হবিগঞ্জ রামকৃঞ্চ মিশন আশ্রমে দূর্গা মন্দির স্থাপন, ১৯৯৬ সালে শ্রীমঙ্গলের রুস্তমপুর গ্রামে শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউড় মন্দির,শ্যামসুন্দর সেবা ট্রাস্ট স্থাপন করেন।
এছাড়াও তিনি বাবার এবং জেঠামহাশয়ের নামে ‘হৃদয়- সদয় শিক্ষা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠাকরেন যা থেকে প্রতি বছর মেধাবী ও গরিব ছাত্র/ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করা হয়।
শচীন্দ্র লাল সরকার অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা, সমাজের সত্যিকারের এক মহানায়ক। তাই তিনি জীবদ্দশায় ১৯৯৭সালে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ধর্মসেবা ও গরিবদের সেবায় দেবোত্তর দান করে গেছেন।
শচীন্দ্রলাল সরকারের দুটি লাইনের কথা মনে পড়লে আজও আমরা শিহরিত হই-
‘’আমার কর্ম,আমার ধর্ম রেখে যাব সবই।
কি আকুলতায় ঘরেছি এই বিদ্যাপীঠ, জানে শুধু অন্তর্যামী”।
বরুন কান্তি সরকার প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান
বিজয়লক্ষ্মী স্কুল এন্ড কলেজ নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।