চলছে শরৎ মৌসুম। আর এই সময়ে বৃষ্টির পানিতে ভরে থাকে খাল, বিল, মাঠ-ঘাটসহ সব নিচু অঞ্চল। পানিতে দেখা যায় বিভিন্ন জাতের ছোট ছোট মাছ। আর সেই মাছ ধরতে জমির আইলে কিংবা অন্য কোনো স্থানে অল্প পানিতে সহজেই মাছ ধরার জনপ্রিয় একটি প্রাচীন উপকরণ হচ্ছে খলশানি বা চাঁই।
বাঁশের তৈরি মাছ ধরার জনপ্রিয় এই ফাঁদটি উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এই খলশানি তৈরির সব উপকরণেরও দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিটি খলশানি প্রকার ও মান ভেদে ২৫০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ত্রিমোহনী ও আবাদপুকুর হাটসহ বিভিন্ন বাজারে খলশানি পট্টিতে বেচা-কেনার জন্য জনসাধারণের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। দেশের অন্যান্য স্থান থেকে পাইকাররা এসে উপজেলার বিভিন্ন হাট থেকে এই খলশানি পাইকারী কিনে নিয়ে যায়।
জানা যায়, উপজেলার নিজামপুর, ঝিনা, খট্টেশ্বর, কৃষ্ণপুর-মালঞ্চিসহ বিভিন্ন গ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের লোকেরা ও তাদের পরিবারের সব সদস্য মিলে প্রতি মৌসুমে খলশানি তৈরি করেন। পরে বিভিন্ন হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। বাঁশ, কটের সুতা ও তালগাছের আঁশ দিয়ে তৈরি এসব খলশানি মানের দিক দিয়ে ভালো হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অঞ্চলভেদে বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে মাছ শিকারিরা এখান থেকে পাইকারি মূল্যে কিনে নিয়ে যায়। ফলে এ পেশায় জড়িত পরিবারগুলো বর্ষা মৌসুমে এর কদর বেশি ও যথাযথ মূল্য পাওয়ায় মাত্র দুই-তিন মাসেই খলশানি বিক্রি করেই তারা প্রায় বছরের খোরাক ঘরে তোলেন।
ঋষি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্যান্য সম্প্রদায়ের কারিগররাও এই খলশানি তৈরি করে থাকেন। তবে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলো ভালো নেই। বছরের কয়েকটি মাস তারা এই খলশানি তৈরি করে সারাবছর সংসার চালানো এই পরিবারগুলোর জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই অবসর সময়ে তারা সরকারের সহযোগিতা চায়। এছাড়া কম সুদে ঋণ দিলে বেশি করে এই খলশানি তৈরি করে নিজেরাই দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করতে পারতো।
উপজেলার ত্রিমোহনী হাটে খলশানি কিনতে আসা ক্রেতা খলিলুর রহমান বলেন, শখের বসে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরতেই এই খলশানি কিনতে হাটে এসেছি। প্রতি বছরই এই খলশানি কিনি। তবে বর্ষা মৌসুমে মাঠে এই খলশানি পেতে মাছ ধরার মজাই আলাদা। তবে দিন যতই যাচ্ছে ততই এই খলশানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঋষিপাড়ার কারিগর ও বিক্রেতা হরিবল এবং মাধব জানান, বর্ষা এলেই খলশানির কদর বাড়ে। হাটবাজারে বিক্রিও ভালো। তবে এখন সারাবছরই টুকটাক খলশানি বিক্রি হয়। প্রতিটি খলশানি তৈরি করতে প্রকার ভেদে খরচ হয় ১৫০-২৫০ টাকা। আর বাজারে প্রতিটি খলশানি বিক্রি হয় ২৫০-৩৫০ টাকা।
তারা আরও জানান, বর্তমানে ছোট জাতের মাছ ধরার সুতি, ভাদায় ও কারেন্ট জালের দাপটের কারণে দেশি প্রযুক্তির বাঁশের তৈরি খলশানি সামগ্রী এমনিতেই টিকে থাকতে পারছে না। কিন্তু জীবনের তাগিদে পৈতৃক এই পেশা ধরে রেখেছেন তারা।
নিজামপুর গ্রামের কারিগর চন্দন সাহা বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই গোত্রের মানুষ। আমাদের পুঁজি বলতে কিছুই নেই। যদি সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো তাহলে আমরা এই খলশানি পেশায় প্রয়োগ করে এই ব্যবসাকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করতাম। আর প্রতিদিনই প্রতিটি জিনিসের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেলে আমাদের বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই পেশাটি ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন, খলশানি একটি প্রাচীন মাছ ধরার উপকরণ। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই খলশানির চাহিদা এখন অনেকটাই কমে গেছে। এই উপজেলায় এই পেশার সঙ্গে যে পরিবারগুলো এখনো যুক্ত আছে আমি তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের চেষ্টা করবো।