
২০২০। পুরো পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেওয়া একটি বছর। ‘কোভিড উনিশে’র ছোবলে ঘরবন্দি মানুষ। সব কিছু থমকে আছে, মরণব্যাধির ভয়ে। কাজ নেই, ঘরে খাবারও নেই। লকডাউনে গাড়ির চাকা বন্ধ হয়ে পড়ায় একই রকম অবস্থা সিলেটের পরিবহন শ্রমিকদেরও। এর মাঝে সামনে আসে পবিত্র ঈদ উল ফিতর। সাহায্যের আশায় ইউনিয়নের শরণাপন্ন হলেন বাস-মাইক্রোবাস চালকরা। ভিক্ষে চান না, তারা। নিজেদের শ্রমে-ঘামে ইউনিয়নের যে তহবিল গড়েছেন সেখান থেকে অনুদান চাইলেন।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা জসিম আহমদসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সংগঠনের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিকের কাছে কল্যাণ ফান্ড থেকে শ্রমিকদের অর্থ সহায়তার দাবি জানান। সেলিম আহমদ ফলিক তাতে সাড়া দেননি। এমনকি তিনি সহায়তার আরজি নিয়ে আসা পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন। ক্ষুব্ধ হন শ্রমিকরা। ঈদের দুদিন আগে তারা নগরের দক্ষিণ সুরমার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। ২০২০ সালের ২ জুন এ ইস্যুতে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় শ্রমিকদের দুই পক্ষ।
২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৯ জুলাই সেলিম আহমদ ফলিককে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে বহিস্কার করা হয়। বেকায়দায় পড়েন ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক। তার এ সর্বনাশে নিজের পৌষ মাস দেখেছিলেন ময়নুল ইসলাম। সেলিম আহমদের প্রতি এ শ্রমিক অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ও সিলেট জেলা বাস মিনিবাস মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশের আশির্বাদে নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ময়নুল ইসলাম।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেলিম আহমদ ফলিককে পরাজিত করে ১৩ হাজার শ্রমিকের সংগঠনের নেতৃত্ব পান ময়নুল। এরপর পেরিয়েছে আরও দেড় বছর, পরিবহন শ্রমিকরা এতোদিনে বুঝে গেছেন- এক দানবকে সরাতে গিয়ে আরেক দানব তৈরি করেছেন তারা। সভাপতি ময়নুল ইসলামের নেতৃত্বে কার্যকরী সভাপতি রুনু মিয়া মঈন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাসনাত, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুহিত, কোষাধ্যক্ষ আবদুস শহীদরা মিলে শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছেন প্রতিনিয়ত।
ময়নুল ইসলাম। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কামালবাজারের মৃত রমিজ আলীর ছেলে। রিকশাচালক বাবার সন্তান ময়নুল ১৯৯১ সালে সিলেট-কামালবাজার লাইনে টেম্পো চালকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে পরিবহন জগতে প্রবেশ করেন। পরে কিছুদিন একই লাইনে মাইক্রোবাসের হেলপারিও করেন। ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ সুরমার সমসু মিয়ার কাছ থেকে গাড়ি চালানো শিখে সুনামগঞ্জ জগন্নাথপুর-লাইনে মাইক্রোবাসের হেলপারি করেন। পরের বছর দক্ষিণ সুরমার মন্দিরখলা এলাকার সাব্বির আহমদের মালিকানাধীন মিনিবাস চালানো শুরু করেন। কয়েকদিন পর এক দুর্ঘটনায় তার গাড়ির চাকায় দুজনের মৃত্যু হলে আত্মগোপন করেন ময়নুল ইসলাম। এরপর মিনিবাস ছেড়ে হেলপারি শুরু করেন সিলেট টু ঢাকা লাইনে মিতালি পরিবহনের বাসে। অল্প কিছু দিন হেলপারির পর ওই পরিবহনের বাসের স্টিয়ারিংও হাতে তুলে নেন ময়নুল ইসলাম। বছর দুয়েক মিতালি পরিবহনের বাস চালানোর পর যুক্ত হন আল মোবারাকা পরিবহনে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত আল মোবারাকার বাস চালান সিলেট-ঢাকা রুটে। পরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক নতুন রূপ পেলে সোহাগ পরিবহনের বাস সার্ভিস সিলেটে নিয়ে আসেন ময়নুল ইসলাম। এ জন্য জামানত হিসেবে সোহাগ পরিবহনের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ গ্রহণ করেন তিনি।
তখন থেকেই মূলত সেলিম আহমদ ফলিকের সাথে ময়নুল ইসলামের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। সেলিম আহমদ ফলিক তখন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সর্বেসর্বা। দুজনের দ্বন্দের কারণে লোকসানের মুখে পড়ে সিলেট থেকে বাস উঠিয়ে নেয় সোহাগ পরিবহন। কিন্তু জামানতের টাকাগুলো ফিরিয়ে দেননি ময়নুল ইসলাম। এই টাকাকেই পুঁজি করেই উত্থান ঘটে তার। তখন থেকেই তিনি টার্মিনাল ভিত্তিক নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে যায় তার নাম। এ সময় তিনি সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে ময়নুল ইসলাম তার ভায়রার পাঠানো ভিসায় পাড়ি জমান মরুর দেশ সৌদি আরবে। কয়েক মাস পর ফিরেও আসেন। সক্রিয় হন পরিবহন রাজনীতিতে। আস্থাভাজন হয়ে উঠেন সিলেট জেলা বাস মিনিবাস মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশের, যার সাথে পরিবহন জগতের রথি-মহারথির উঠাবসা। এতদিন সেলিম আহমদ ফলিকই ছিলেন জিয়াউল কবির পলাশের ‘ডান হাত’। জিয়াউল কবির পলাশের প্রশ্রয়ে সেলিম আহমদ ফলিকই এতদিন নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন সিলেটের পরিবহন সেক্টর। জিয়াউল কবির পলাশের মনে হচ্ছিলো, সেলিম আহমদ ফলিক তার মুঠো থেকে যাচ্ছেন। ফলিককে ছুড়ে ফেলে পলাশ তখন কাছে টেনে নেন ময়নুল ইসলামকে। ২০২১ সালে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে ময়নুলকে বিজয়ী করতে মোটা অঙ্কের টাকাও লগ্নি করেন পলাশ।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে এখন ময়নুল ইসলামের এক তরফা আধিপত্য। যার মানে পকেটে কাঁচা টাকার ছড়াছড়ি। বাড়তে থাকে তার সম্পদ। বর্তমানে তার নোয়াহ ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস রয়েছে ৫টি, হাইয়েস ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস রয়েছে ২টি, প্রাইভেট কার ২টি, সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে ৫টি। এর বাইরে নিয়মিত আয় হিসেবে ৩৬ হাজার শ্রমিকের দৈনিক চাঁদার একটি অংশ যায় তার পকেটে। বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার থেকেও চাঁদা আসে প্রতি মাসে অন্তত ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। ফিটনেস বিহীন গাড়িকে সড়কে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়ে মাসে আয় করেন কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। টার্মিনাল কেন্দ্রিক চোর, প্রতারক ও মাদক সিন্ডিকেটের কাছ থেকে মাসিক হারে ভালো অঙ্কের চাঁদাও পান ময়নুল ইসলাম। আয় আছে টার্মিনাল কেন্দ্রিক সালিশ থেকেও। পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ-বিবাদের সালিশ মীমাংসার জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেন ময়নুল ইসলাম-এমন অভিযোগ খোদ শ্রমিকদেরই। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সেটাও ময়নুল ইসলামসহ শ্রমিক নেতাদের আয়ের কারণ হয়। ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিবহন কর্তৃপক্ষ যে টাকা নিহতের পরিবারকে দেয় তার দুই তৃতীয়াংশই শ্রমিক নেতারা ভাগ করেন নিজেদের মাঝে। এ ছাড়া ৬২টি উপশাখা মিলিয়ে নতুন সদস্য ভর্তি সদস্য নবায়ন মিলিয়ে বছরে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা আয় হয়। ৬২ উপশাখার নির্বাচন থেকেও আয় আছে। একেকটি নির্বাচন থেকে অন্তত ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় হয় শ্রমিক ইউনিয়নের। এসব আয়ের বড় একটা ভাগ যায় ময়নুল ইসলামের পকেটে। নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করিয়েও পকেট ভারি করেন ময়নুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, ক্যামি ব্র্যান্ডের যে গাড়িটি ময়নুল ইসলাম ব্যবহার করছেন তা উপহার দিয়েছেন ওসমানী বিমানবন্দর উপশাখার সভাপতি হেলাল আহমদ। ওই উপশাখার শ্রমিকদের ভাষ্য, ময়নুল ইসলামের কারসাজিতেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন হেলাল আহমদ।
প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার পালা। একাত্তরের কথা থেকে কল দেওয়া হয় ময়নুল ইসলামের মোবাইল ফোনে। বন্ধ পাওয়া যায় ফোন নম্বরটি। বার কয়েক ফোন দিয়েও সংযোগ মেলেনি। ময়নুল ইসলামের কাহিনী তাই এখানেই শেষ হচ্ছে। কালকের পত্রিকার পাতায় আমরা তুলে ধরবো অন্যদের কাহিনী।
সূত্র : একাত্তরের কথা