
মো:সিরাজুল ইসলাম পলাশ
লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি
লালমনিরহাটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক ছেলের তিন বিয়ের ঘটনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় লালমনিরহাটের চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার।
রংপুর আদালতে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী ওমর আলী। তিনি আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষকেও কর্মরত।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা হলেন,বিজনেস বাংলাদেশের লালমনিরহাট প্রতিনিধি আশরাফুল হক, এশিয়ান টিভি ও জবাবদিহি পত্রিকার নিয়ন দুলাল, দৈনিক নবচেতনার লিয়াকত আলী ও দৈনিক লাখোকণ্ঠের আব্দুর রাজ্জাক।
জানা গেছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজু মিয়া আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে। রাজুর জন্ম সনদ (জন্ম তারিখ- ১৫/১২/২০০৩) অনুযায়ী বয়স ২০ বছর হলেও আইন অনুযায়ী ২১ বছরের আগে বিয়ের সুযোগ নেই। অথচ ২০ বছরে বয়সেই তিন বিয়ে ও দুটি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে তার।
এর আগে ঘটনাটি নিয়ে ‘ঢাকা মেইল’-এ ‘কাজীর কারসাজিতে অনিশ্চিত বাল্যবিয়ের শিকার রূপালীর ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে গত ১৯ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজু মিয়া দুই বছর আগে প্রায় ১৮ বছর বয়সে মোগলহাট ইউনিয়নের ভাটিবাড়ি গ্রামের ফজলু হকের কিশোরী মেয়ে ফারজানাকে বিয়ে করে। বর কনে দুজনের বয়স কম থাকায় বিয়ে রেজিস্ট্রি হলেও নকল দেননি কাজী ওমর আলী। বিয়ের এক বছরের মধ্যে অপর এক নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। তবে বিয়ে রেজিস্ট্রির নকল না থাকায় আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি মেয়ের পরিবার।
বিচ্ছেদের পরে একইভাবে দুর্গাপুর গ্রামের আমিনুল হকের মেয়ে স্থানীয় ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী খাতুনকে (১৩) দ্বিতীয় বিয়ে করে রাজু মিয়া। দ্বিতীয় বিয়েও রেজিস্ট্রি করেন মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার ও রুপালীর স্কুলের মৌলভি শিক্ষক কাজী ওমর আলী। বর ও কনে দুজনেই অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় এ বিয়েরও নকল দেননি কাজী ওমর আলী। সেই বিয়েতেও এক মাস পরে বিচ্ছেদের সুর বেজে ওঠে। আবারও সমস্যায় পড়েন বর ও কনের পরিবার। নকল না দেওয়ায় কোনো পক্ষ নিতে পারছিলেন না আইনি পদক্ষেপ।
অবশেষে রাজু মিয়া রুপালীকে বিয়ে করেছেন মর্মে কাজী ওমর আলী লিখিত দিলে গত বছরের ২৪ নভেম্বর তাদের বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। তবে এ বিচ্ছেদের নোটিশ ফেরত পাঠান রুপালীর পরিবার। রাজুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিয়ের নকল চেয়ে দফায় দফায় নিকাহ রেজিস্ট্রার ওমর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রুপালীর পরিবার। এদিকে রাজু পুনরায় প্রথম স্ত্রীকে তৃতীয়বার বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান।
বার বার নাবালক ছেলের বাল্যবিয়ে দিয়ে নিবন্ধনের মাসুল (ফি) আদায় করলেও নকল না দেওয়ায় আলোচনায় আসেন কাজী ওমর আলী। নিজে শিক্ষক হয়ে তারই বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ে দিয়ে বৈধ কাগজ না দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেন কাজী ওমর আলী। বিষয়টি স্থানীয় সূত্রে জানাতে পেরে অনুসন্ধানে নামেন সাংবাদিকরা। পরে রুপালীর পরিবারের সদস্য, বিয়ের সাক্ষী, ঘটকসহ সংশ্লিষ্টদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয় অনেক গণমাধ্যমে।
সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলা রেজিস্ট্রার লিখিত কৈফিয়ত তলব করে মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিটার কাজী ওমর আলীকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৫ জানুয়ারি উল্লেখিত চার সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রংপুর সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেন কাজী ওমর আলী। পরে বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করতে লালমনিরহাট সদর থানা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়।
এ বিষয়ে সাংবাদিক আশরাফুল হক বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীর পরিবার বিয়ের নকল না পেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছে এমন অভিযোগে ভিক্টিম, তার পরিবার ও বিয়ের স্বাক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট সবার ভিডিও সাক্ষাৎকার ও প্রমাণিক কিছু দলিল সংগ্রহ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। এমনকি ওমর আলী নিজে স্বীকার করেছেন রাজুর প্রথম বিয়ে দেওয়ার কথা যার ভিডিও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের শায়েস্তা করতে মিথ্যে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার। যা আইনিভাবেই আমরা মোকাবেলা করব।
সাত বছর আগে লালমনিরহাট জেলাকে ‘বাল্য বিয়ে মুক্ত’ জেলা হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। সচেতন মানুষজন বলছেন, কিছু অসাধু নিকাহ রেজিস্ট্রারের কারনে সরকারের এ মহতী উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। গ্রামে-গঞ্জে হরহামেশাই ঘটছে বাল্য বিয়ের ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, জেলার অনেক নিকাহ রেজিস্টারের গোপন ভলিয়ম রয়েছে। বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি হয় গোপন ভলিয়মে। যার নকল প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত দেওয়া হয় না। বাল্যবিয়ে দেওয়া অপরাধ ভেবে অভিভাবকরাও বিয়ের সময় নকল দাবি করেন না। সংসারে বনিবনা না ঘটলেই নকল খোঁজে উভয় পরিবার। নকল না পেয়ে অনেক মেয়ের পরিবার নিতে পারছেন না আইনি কোনো পদক্ষেপ। ফলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন অনেকেই। আবার কতিপয় অর্থলোভী নিকাহ রেজিস্টারের কারনে অনেক কিশোর কিশোরী শিক্ষাজীবন ছেড়ে টানছেন সংসারের ঘানি। কেউ আবার সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে কিশোরী বয়সেই নিতে হচ্ছে স্বামী পরিত্যক্তার গ্লানি।
ছাবেরা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক নিজে নিকাহ রেজিস্টার হওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। নিজস্ব ইউনিয়নের বাহিরে বিবাহ রেজিস্ট্রি করা বিধি বহির্ভুত হলেও স্কুলশিক্ষক হিসেবে দুর্গাপুরে যাতায়াত করায় দুর্গাপুরে বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করেন মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। এমন অভিযোগ তুলে দুর্গাপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী মাহমুদুল হাসান জুয়েল বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অভিভাবকরা বিয়ের জন্য আসলে আমি তাদেরকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠাই। অথচ মোগলহাটের নিকাহ রেজিস্টার দুর্গাপুরের স্কুল শিক্ষক হিসেবে এসব বাল্যবিয়ে পড়াচ্ছেন। হাতেনাতে বাল্যবিয়ে রেজিস্টির দৃশ্য দেখে তাকে নিষেধ করেছি। কিন্তু তিনি তা মানছেন না। তার কারণেই দুর্গাপুরে বাল্যবিয়ে বাড়ছে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ বাল্যবিয়ের দায়ে কাজী ওমর আলীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। এতকিছুর পরেও তিনি সতর্ক হচ্ছেন না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার ওমর আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রুপালীর সঙ্গে রাজুর দ্বিতীয় বিয়ে আমি রেজিস্ট্রি করিনি।
রাজুর প্রথম বিয়ের বর-কনে অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকলেও সে বাল্যবিয়ে কীভাবে দিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এরকম কোনো কথা আমি বলিনি। তবে সাংবাদিক আশরাফুল হকের ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই ভিডিওতে তিনি নিজে রাজুর প্রথম বিয়ে ও বিচ্ছেদ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র সাহা বলেন, বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক ওমর আলী নিকাহ রেজিস্টার কাজের জন্য বিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেননি। আর আমার বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ের ঘটনাটি গণমাধ্যমে জেনেছি।
বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, আমরা বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দেখাতে প্রায় সমাবেশ করে থাকি। সেখানে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে বক্তব্য দেন মৌলভী শিক্ষক কাজী ওমর আলী। তিনি যদি বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করেন তবে তা দুঃখজনক। আমরা তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেব।
সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, আদালতের নির্দেশে অভিযোগটি তদন্ত চলছে। তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
জেলা রেজিস্টার খালিদ বিন আসাদ বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রায় সমাবেশ করা হচ্ছে। নিকাহ রেজিস্টারদের অধিক্ষেত্রের বাহিরে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার কোনো নিয়ম নেই। মেয়ের ১৮ এবং ছেলের ২১ বছরের আগে বিয়ে আইনত অপরাধ। বাল্যবিয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তসহ অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গোপন ভলিয়মে বাল্যবিয়ে ও ভুয়া বিচ্ছেদ ঠেকাতে বিবাহ নিবন্ধন ডিজিটাল করার প্রস্তাব করেন তিনি। যেখানে বিবাহ এবং বিচ্ছেদের তথ্য অনলাইনে থাকবে। যা তাৎক্ষণিক নকলও পাওয়া সম্ভব হবে। এমনটা করা হলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে বলেও জানান তিনি।