পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের ফাদুর ছড়া এলাকার সেভেন বিএম ইট ভাটায় পাহাড় কাটা হচ্ছে ও জ্বালানোর জন্য মজুদ করা হয়েছে বনের গাছ কেটে হাজার হাজার ঘনফুট লাকড়ি।
"কত কে এলো গেল, কত জন আসবে" আমরা ঠিকই ভাটা চালাবো। যারা ইট ভাটা বন্ধ করবে (পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান) তাদের সাথে আমাদের টেবিল সম্পর্ক। ঊনারা এখানে এসে দেশি মুরগি খেয়ে যায়। শুধু খায় না, নিয়েও যান। এবছর নতুন ইটভাটা করতে ১২ লাখ ও প্রতিটি অবৈধ ইট ভাটার জন্য ৪ লাখ করে দেয়া হয়েছে। মাঝে মধ্যে টুক টাক যে অভিযান করে তা নাটক মাত্র, লোক দেখানো মাত্র অভিযন। গত ২১ বছরের ফাইতং এর একটি ইট ভাটাও কি ভাংতে পেরেছে প্রশাসন ! এভাবে উচ্চ কন্ঠে দম্ভ দেখিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলেন লামার ফাইতং ফাদুর ছড়া এলাকার সেভেন বিএম ও ইউবিএম ইট ভাটার মালিক কবির খান।
সরোজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ফাইতং ইউনিয়নের ফাদুর ছড়া গ্রামে এই বছর নতুন করে নির্মিত সেভেন বিএম ইট ভাটা তিন পাশে স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কাটছে। ইতি মধ্যে দুইটি বিশাল পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে এই ইট ভাটাটি। নতুন করে আরও একটি পাহাড় কাটা শুরু করেছে। জ্বালানী হিসাবে মজুদ করা হয়েছে পাহাড়ি বনের হাজার হাজার ঘনফুট লাকড়ি। এই বিষয়ে কথা হয় এই ভাটার মালিক কবির খানের সাথে। তিনি বলেন, "অনুমতি না থাকলেও সবাইকে ম্যানেজ করেই কাজ শুরু করেছি। এখন ভাটা করতে অনুমতি লাগেনা"।
বিগত ২১ বছরে হারিয়ে গেছে পার্বত্য এই অঞ্চলের প্রায় দেড় শতাধিক ছোট বড় পাহাড়।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (যুগ্নসচিব) হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, "অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ইট ভাটা চালু রাখতে সহযোগিতা করার বিষয়ে তদন্ত করা হবে। ইট ভাটার পাহাড় কাটা ও বনের লাকড়ি পুড়ানোর বিষয়ে হোয়াটস অ্যাপে ছবি ও তথ্য দেন। আমরা ব্যবস্থা নিব"।
স্থানীয়রা জানায়, ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে গড়ে উঠা ২৮টি ইট ভাটার সব গুলো ভাটা স্কুল, জন বসতী গ্রাম, সবুজ বনাঞ্চল, খালের পাড় এবং সড়কের পাশে তৈরী করা হয়েছে। গেল বর্ষা থেকে শুরু করে ইট ভাটা গুলো স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে যাচ্ছে। ভাটার একমাত্র কাঁচা মাল মজুদ মাটি শেষ হওয়ায় নতুন করে আবারো ২৮টি ইট ভাটা স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটছে। যা দেখেও টিনের চশমা দিয়ে আছে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান।
ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধভাবে গড়ে উঠা ভাটার কারণে পাহাড়ের প্রকৃতির সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। এমনকি উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের পাগলীর ছড়া থেকে শিবাতলী পর্যন্ত ৫ কিঃ মিঃ জায়গায় গড়ে উঠেছে ২৮টি ইট ভাটা। এই বছর পাগলীর ছড়া এলাকায় বিএমডব্লিউ এবং ফাদুর ছড়া এলাকায় সেভেন বিএম নামে নতুন করে আরও দুইটি ইট ভাটা সৃষ্টি হয়েছে।
ফাইতং মৌজা হেডম্যান উম্রামং মার্মা বলেন, "২০০৩ সালে ফাইতং ফাদুর ছড়া এলাকায় দিদার মৌলভী ও সালেহ আহমদ নামে দুই ব্যক্তি ইউবিএম নামে একটি ভাটার মধ্য দিয়ে ইট ভাটা কার্যক্রম শুরু করে। তারপর থেকে বাড়তে বাড়তে এখানে এখন ভাটা প্রায় ৩০টি। যদিও এই বছর দুইটি ভাটা বন্ধ রয়েছে। এলাকায় যন্ত্রের গর্জন ও ধূলোবালুতে সবুজ প্রকৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। গত ২১ বছরে প্রায় দেড় শতাধিক পাহাড় হারিয়ে গেছে"।
শুধু মাত্র ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে ২৮টি অবৈধ ইট ভাটা থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন অত্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক। তিনি বলেন, "কোন প্রকার অনুমতি, অনুমোদন ও ছাড়পত্র ছাড়াই বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টি ইট ভাটা গড়ে উঠেছে"।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুসারে লাইসেন্স ব্যতীত কোনো ইট ভাটা স্থাপন অবৈধ। ইট ভাটাগুলো কার্যক্রম শুরু এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের প্রস্তুতি গ্রহণ না করার আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। বর্ষা ঋতুর পর পরই পাহাড়ে সবুজ প্রকৃতি সাজতে শুরু হলেও সেই পাহাড়ের বুকে আঘাত শুরু করেছে ইট ভাটার মালিকরা।
ফাইতং ইউনিয়নের মেঅং পাড়ার বাসিন্দা চিংহ্লামং মারমা ও মংবাচিং মারমা বলেছেন, "শুধু এবছর নয়, কয়েক বছর ধরে কাটতে কাটতে পাড়ার পাশের পাহাড়টি এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। তিনি আরো জানান, যেভাবে দিন-রাত অবিরাম কাটা হচ্ছে, তাতে কয়েক বছর পরে আর পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকবে না। পাহাড় কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করত। ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী। পাহাড় কাটতে বাধা দিলে তারা মামলা-হামলার হুমকি দেয়"।
লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল হক বেলাল জানিয়েছেন, "অবৈধ লাকড়ি পুড়ানোর বিষয়ে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। আজ বুধবার (১৩ মার্চ) ফাইতং সেভেনবিএম ইটভাটায় অবৈধ লাকড়ির বিষয়ে অভিযান চলছে"।
এ বিষয়ে বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক মোঃ ফখর উদ্দিন চৌধুরী এর মুঠোফোনে অসংখ্যবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, "আমি সদ্য যোগদান করেছি। অবৈধভাবে পাহাড় কাটার বিষয়ে ইট ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে"।
অত্র উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৭টি, গজালিয়া ইউনিয়নে ২টি, সরই ইউনিয়নে ১টি ও লামা পৌরসভায় ১টি ইট ভাটা সহ মোট ৩৯টি অবৈধ ইট ভাটা চালু রয়েছে। সচেতন মহল মনে করেন, ইট ভাটা গুলোর লাগাম টেনে ধরা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।