বাড়িঅন্যান্যগণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের শঙ্কা

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের শঙ্কা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণা করায় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এতে তথ্য পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ এবং সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে বলে অংশীজনরা মনে করছেন। সরকার অবশ্য বলছে, এ সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই।

তথ্য পরিকাঠামো হলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক, যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। আইন অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। বেআইনিভাবে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন বা ক্ষতির চেষ্টা করলে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

গণমাধ্যম-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হতে পারে। এ জন্য বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন; নয়তো এসব প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হবেন। গণমাধ্যমকর্মীরা চাপে থাকার পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতে, গণমাধ্যমকে চাপে রাখতে তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় নতুন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মাধ্যম তথ্য পরিকাঠামোর আওতাভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে পুরো প্রতিষ্ঠানকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে তথ্য পরিকাঠামোর আওতাভুক্ত করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ধারা ১৫-এর ক্ষমতাবলে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

এটি প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন মহল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তবে গত রোববার এ বিষয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে আইসিটি বিভাগ জানিয়েছে, ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।’ ভারত, কোরিয়া, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো চিহ্নিত রয়েছে।

বাংলাদেশে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড, সেতু বিভাগ, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জাতীয় ডাটা সেন্টার (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগ (নির্বাচন কমিশন সচিবালয়), সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।

তথ্য পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের বিষয়টিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় আনার কারণ সরকার শিগগিরই জানিয়ে দেবে।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করাই হয়েছে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য। তবে এটা অস্বীকার করব না যে, একটা সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে এবং এটি যখন আমাদের নজরে এসেছে, তখনই কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। গণমাধ্যমে কর্মরত কারও এই আইন নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সমকালকে বলেন, তথ্য পরিকাঠামোয় কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। তথ্য অধিকার আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মিলিয়ে দেখতে হবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে বলা যাবে। তবে এটা ঠিক, ডিজিটাল মাধ্যমে যে কোনো ধরনের হ্যাক করা বা এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিবেচনাপ্রসূত। এর ফলে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ বা তথ্য অধিকার আইনের অধীন তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কম্পিউটার নেটওয়ার্কের পরিবর্তে পুরো প্রতিষ্ঠানকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

তথ্য কমিশনের সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানকে তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় আনা হয়েছে, সেগুলোর ডিজিটাল মাধ্যম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি, পুরো প্রতিষ্ঠানকেই তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে গণমাধ্যম ও নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। তিনি আরও বলেন, এ মাসেই সম্পাদক পরিষদের মিটিং আছে। সেখানে বিষয়টি আলোচনা হবে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী সমকালকে বলেন, তথ্য পাওয়ার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় তথ্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানকে তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় আনার ফলে তা বিঘ্নিত হবে। এর ফলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। একইভাবে অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে এসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments