
করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এর সঙ্গে প্রিয়জনের সংক্রমণ ও মৃত্যু এবং অস্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি গেল আড়াই বছরে মানুষের মনে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রভাবে আগামীতে মানসিক স্বাস্থ্যে নীরব মহামারি সৃষ্টি করবে। সম্প্রতি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনা সংকটে মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি) বা শুচিবাই রোগ বেড়েছে। ফলে বেড়ে গেছে আত্মহত্যার প্রবণতাও।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে আগামীকাল সোমবার পালিত হবে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও সামাজিক সংগঠন আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের ১০টি রোগের মধ্যে ওসিডির অবস্থান তৃতীয়। ওসিডি নানা রকম হতে পারে। একই কাজ বারবার করতে থাকা, অস্থিরতা, যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রবল উদ্বেগ, ডিপ্রেশন এই রোগের অন্যতম উপসর্গ। ওসিডি মানুষকে এতটায় যন্ত্রণা দেয় যে, তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে ওসিডি আক্রান্তদের ১৯ শতাংশের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। দেশে মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের মধ্যে অন্যান্য কী ধরনের সমস্যা রয়েছে, তা জানতেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও মনোবিদ অধ্যাপক মোহিত কামালের নেতৃত্বে এ জরিপ করা হয়।
জরিপে চলতি বছরে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৮৩৪ মানসিক রোগীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। যাদের মধ্যে ১৫৩ জনের ওসিডি পাওয়া গেছে এবং তাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি। করোনার প্রভাবে দেশে ১৮ শতাংশ মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের নতুন করে ওসিডি ধরা পড়েছে, যাদের জন্মগতভাবে রোগটি ছিল না। ওসিডি ধরা পড়াদের মধ্যে ১৯ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত জাতীয় এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশের ওসিডি ছিল।
গতকাল শনিবার আঁচল ফাউন্ডেশন এক সংবাদ সম্মেলনে ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১ হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থী অংশ নেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৯ মাসে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৪০৪ শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৫৭, স্কুলের ২১৯, মাদ্রাসার ৪৪ ও কলেজপড়ূয়া আছে ৮৪ জন। আত্মহত্যা করাদের মধ্যে ছাত্রী ২৪২ ও ছাত্র ১৬২।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, করোনা-পরবর্তী ১ হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থীর ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ জানিয়েছেন তাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর করোনা সংকটে আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাঁরা করোনা-পরবর্তী একাডেমিক চাপের কারণে নানা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত, সঠিক পরিচর্যা পেলে মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও মনোবিদ অধ্যাপক মোহিত কামাল সমকালকে বলেন, করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে বাড়তি মানসিক চাপে বেড়েছে আত্মহত্যা প্রবণতা। সবচেয়ে উদ্বেগের হলো, দেশে ওসিডি রোগী বাড়ছে। ওসিডি বাড়লে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়বে। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচি দরকার। এসব বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দসহ জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।